তুরস্ক হঠাৎ করে সিরিয়া আক্রমণ করে বসেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় রাজনৈতিক বিভক্তি ও গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায় দুই কোটি মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটছে প্রতিদিন, যেমন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর। জলবায়ু
পরিবর্তনের কারণে দ্রুত বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পৃথিবী। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর প্রেসিডেন্ট পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘পৃথিবীর কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবো, তাতেই আছে অধিক দেশপ্রেম।’ ১৬ বছরের একটি মেয়ে এসে বিশ্বনেতাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘তোমরা অথর্ব, অকেজো। জায়গা ছেড়ে দাও, আমরা আসছি।’
অথচ এর কোনোটাই হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৪৫ সালে যখন জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়, তখন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো হাতে হাত রেখে বলেছিল, ‘বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। আমরা একসঙ্গে শুধু যুদ্ধই ঠেকাব না, দারিদ্র্য হটাব, মানবাধিকার সমুন্নত রাখব। এই পৃথিবী ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল সবার জন্য বাসযোগ্য করব।’
যারা সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ঠিক উল্টো কাজটা সবচেয়ে বেশি করছে তারাই। পৃথিবীর সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তন। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নির্ধারিত মাত্রার নিচে কমানো সম্ভব না হলে এক অনিবার্য বিপর্যয়ের মুখে পড়বে সবাই। আর সে কাজ করার সময় হাতে আছে মাত্র ১০ বছর। সে বিপদ এড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্বের দেশগুলো জলবায়ু প্রশ্নে প্যারিসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১৬ সালে। সেই চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে হাত লাগানোর বদলে তা থেকে বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
শুধু প্যারিস চুক্তি নয়, যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে বহুজাতিক বিশ্বব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তুলছে। তারা ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন বিশ্ব ডাক সংস্থা থেকেও সরে আসার কথা তারা ভাবছে বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন। এর আগে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে তিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সর্বশেষ জানা গেল, এই সংস্থাকে চাঁদা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ওয়াশিংটনের কাছে জাতিসংঘের বকেয়া প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের মহাসচিব বিপদঘণ্টা বাজিয়ে বলেছেন, বকেয়া পরিশোধ না করা হলে এই সংস্থার কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না।
পরিহাসের বিষয় হলো, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে দেশগুলো জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্র। ‘ইউনাইটেড নেশনস’—এই নামের প্রস্তাব করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। তাঁর স্ত্রী ইলানোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার খসড়া লেখায়। সাত দশক পর এখন সেই যুক্তরাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিচ্ছে জাতিসংঘকে অকেজো করে তুলতে।
জাতিসংঘ ব্যবস্থা একটা খুব সাধারণ প্রস্তাবনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর মানুষ যদি এককাট্টা হয়ে কাজ করে, তাহলে যুদ্ধ থেকে মহামারি, দারিদ্র্য অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘন—কোনো সমস্যা মোকাবিলাই অসম্ভব নয়। একটা সময় ছিল, যখন বিশ্বের দেশগুলো আপেক্ষিক বিচ্ছিন্নতায় বাস করতে পারত। কিন্তু বিশ শতকে তা সম্ভব নয়। আমরা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছি যে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। শান্তিরক্ষা থেকে জলবায়ু সংকট, বিশ্ব বাণিজ্য বিরোধ থেকে এইডসের মতো মহামারি, এর কোনোটাই একা একা সমাধান সম্ভব নয়। যুদ্ধ করে সাময়িক জয় হয়তো সম্ভব, কিন্তু শান্তি অর্জন করতে হলে অনেকের সমর্থন লাগবেই।
একুশ শতকে এসে এই ভাবনা উল্টে গেল আর তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই বলে এসেছেন, বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে কী হচ্ছে না, সে কথা ভাবার সময় তাঁর নেই। তাঁর স্লোগান, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’—আগে নিজের কথা ভাবতে হবে, নিজের স্বার্থকে রক্ষা করতে হবে। এ বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে এসে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘গ্লোবালিজম’-এর দিন শেষ। বলাই বাহুল্য, গ্লোবালিজম বলতে ট্রাম্প বহুপাক্ষিকতাবাদের কথাই বুঝিয়েছেন, যে নীতি বা আদর্শ জাতিসংঘের জন্মসূত্র।
পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তিধর দেশ হওয়ার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্র নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ী আরও তিনটি দেশ ও চীনকেও একই মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল এই বিবেচনা থেকে যে এরা শুধু অধিক দায়িত্বই পালন করবে না, বিশ্বকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে নেতৃত্ব দেবে। বলাই বাহুল্য, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জাতিসংঘ যে আজ তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, তার প্রধান কারণই হলো এর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর, বিশেষত শক্তিধর দেশগুলোর নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা।
জাতিসংঘ পৃথিবীর মানুষকে কতটা হতাশ করেছে, তার আরেক প্রমাণ মিলল এ বছরে সাধারণ পরিষদে আয়োজিত জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে। বিশ্বের সব নেতা যে হলে বসেছিলেন, সেখানে তাঁদের সামনে ১৬ বছরের গ্রেটা থুনবার্গ বলেছে, ‘আপনারা কেবল কথাই কপচিয়েছেন। আমাদের আশা দিয়েছেন, অথচ সে আশা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এখন আপনারা বলছেন আমাদের মতো তরুণদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন আশার কথা শুনতে। আপনাদের এ কথা বলতে লজ্জা করে না?’
এই সম্মেলনের আগে নিউইয়র্কে এক বিক্ষোভ সমাবেশে ভাষণ দেয় গ্রেটা। লাখখানেক বা তার চেয়ে বেশি মানুষ তাতে যোগ দিয়েছিল, যার অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী। বক্তাদের মধ্যে বাংলাদেশের একটি কিশোরীও ছিল, যে একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর হয়ে বক্তব্য দেয়। এদের কথা শুনে, আশপাশের তরুণদের দিকে তাকিয়ে আমার মনে আশা জেগেছিল, এরা যখন নেতৃত্ব নেবে, বিশ্বের চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু তত দিন অপেক্ষা করার মতো সময় আমাদের হাতে আছে তো?
গ্রেটা থুনবার্গ জাতিসংঘে এসে বিশ্বনেতাদের তাঁদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য ধমক দিয়ে গেল, তার অর্থ এই নয় যে সে জাতিসংঘকে অপ্রয়োজনীয় বলে নির্দেশ করেছে। ঠিক উল্টো, সে বিশ্বনেতাদের চোখে আঙুল দিয়ে শুধু এই কথা বোঝাতে চেয়েছিল, ‘এই পৃথিবী আমাদের সবার, আমরাই পারি এর অসুখ সারিয়ে তুলতে। আমি তোমাদের কন্যা, আমাকে যদি ভালোবাসো, এই পৃথিবীকে তোমাকে ভালোবাসতে হবে।’ কানে বাজছে, নিউইয়র্কের বিক্ষোভ সমাবেশে গ্রেটা থুনবার্গ জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বের নেতারা আমাদের কথা শুনতে পান না। আমাদের কথা যাতে তাঁরা শুনতে পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
গ্রেটার বলা কথার মোদ্দা অর্থ হলো জাতিসংঘ যে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে, সে দায়ভার এই সংস্থার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর। যুক্তরাষ্ট্র আজ খোলামেলাভাবেই জাতিসংঘের মৌল আদর্শের বিরোধিতা করছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রস্তাব করেছেন, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো দেশে যা ইতিমধ্যে আদৃত হয়েছে; তা যদি টিকে যায়, তাহলে জাতিসংঘ শুধু তার কার্যকারিতা হারাবে তা-ই নয়, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকও হয়ে পড়বে।
অথচ বাস্তবতা হলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জাতিসংঘকে আজ আমাদের বেশি প্রয়োজন। কারণ হিসেবে জলবায়ু সংকটের কথাটাই ভাবুন। এই সংকট কোনো এক দেশের সৃষ্টি নয়, কোনো এক দেশের পক্ষে সে সংকটের সমাধানও সম্ভব নয়। সমাধানের পথ খুঁজে পেতে হলে সবার আগে চাই এমন একটি জায়গা, যেখানে পৃথিবীর দেশগুলো একজোট হওয়ার সুযোগ পাবে, যেখানে একে অপরের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হবে। জাতিসংঘ ঠিক সেই ক্ষেত্র। বলছি বটে জাতিসংঘ তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, কিন্তু কাল যদি এই সংস্থার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে আশার শেষ আলোটুকু নিভে যাবে। তখন পৃথিবীর মানুষকে ফের জাতিসংঘের মতো আরেকটি সংস্থা গঠনের কথা ভাবতে হবে, তা যে নামেই তাকে ডাকি না কেন।
যে সহজ কথাটি ১৬ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে বোঝে, বিশ্বের নেতারা তা বোঝেন না দেখে আমাদের বিস্ময় জাগে। কিন্তু সেখানে বসে থাকলেই চলবে না। অবস্থা বদলাতে হবে, নির্বাচিত করতে হবে এমন নেতাদের, যাঁরা কেবল নিজের স্বার্থ না ভেবে আমাদের সম্মিলিত স্বার্থের কথা বিবেচনা করবেন।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক