পুতিন

জাগরণ ও সমন্বয়ে আজকের রাশিয়া

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি

সেদিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ফিরে আসবে না, এটা অন্তত রাশিয়ার মানুষ জানে। তারা চায়ও না। কিন্তু যে দেশটিকে তিন দশক আগেও সবাই মান্য করত, যে দেশ পরাশক্তি হিসেবে সারা বিশ্বের সমীহ আদায় করত, সে দেশের এমন করুণ পরিণতি রাশিয়ার মানুষকে কষ্ট দেয়। তাই এখন তারা আবার উঠে দাঁড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর যাঁর নেতৃত্বে এই প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন তারা করতে চায়, তিনি হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কারণ, ইতিমধ্যে পুতিন রাশিয়ানদের মধ্যে পুনর্জাগরণের নেতা হিসেবে ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
এবার ৭ অক্টোবর রাশিয়ায় থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার, দিনটি ছিল ভ্লাদিমির পুতিনের জন্মদিন আর সবাই হা-পিত্যেশ করছিল, কেন তাঁর পঁয়ষট্টি হলো, কেন পঞ্চাশই থাকল না! তিনি যে সময় রাশিয়ার ক্ষমতায় আসেন, সে সময়টা পুরো রাশিয়া যেন ছিল তলিয়ে যেতে থাকা এক জাহাজের মতো, যার সামান্যই জলে ভাসমান। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় এসে রুশদের ঘুরে দাঁড়ানোর নেতৃত্ব হাতে নেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন রাশিয়ার যে দরজাগুলো খুলে দেন, তাতে পশ্চিমের বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে অনেক আবর্জনা রাশিয়ায় প্রবেশ করে। আমেরিকার ভোগবাদী জীবনের আলোটুকু দেখেই তরুণসমাজ উন্মাদনায় অধীর হয়। এ সময়ই রাশিয়ার সমাজে প্রকাশ্য অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সুযোগে সোভিয়েত-যুগে যে রুবলের মূল্য ছিল ডলারের চেয়ে বেশি, রাশিয়ার সেই রুবল ডলারের কাছে দাঁড়াতেই পারে না। পুতিন ক্ষমতায় এসে রাশিয়ার পতন ঠেকাতে চেষ্টা করেন।
পুতিন মূলত ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ২০১২ সাল থেকে আজ অবধি প্রেসিডেন্ট আছেন। টানা দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকা যায় না—এমন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য মাঝের সময়টুকু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পুতিন দিয়েছেন ‘নয়া রাশিয়া’র ডাক। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্বাধীন দেশগুলো যখন চরম অর্থনৈতিক মন্দায় পতিত হয়, তখন সেখান থেকে দলে দলে মানুষ রাশিয়ায় আসতে থাকে; কমিউনিস্ট মতাবলম্বীদের ওপর রাষ্ট্রীয় পীড়ন চলে; একটা অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় রুশরা।
পুতিন এসে সবাইকে নিয়ে রাশিয়াকে ঘুরে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন। তাই বন্ধ হয়ে যাওয়া গির্জাগুলোতে যেমন এখন আলো ঝলসায় ও ঘণ্টা বাজে, তেমনি রাস্তায় রাস্তায় কার্ল মার্ক্স, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনসহ অন্য সমাজতন্ত্রীদের ভাস্কর্য এখনো শোভা পায়। লেনিনের মমি এখনো আগের মতো আগের স্থানেই শ্রদ্ধার সঙ্গে শায়িত আছে। অতি উৎসাহীদের অনেকে বলেছিলেন, মৃতদেহ এভাবে মমি করে রাখা ধর্ম-অনুমোদিত নয়; পাশেই ইয়োসেফ স্তালিনসহ অন্য সোভিয়েত নেতাদের পাশে লেনিনকেও সমাধিস্থ করা হোক। পুতিন তা করেননি। না করে তিনি লেনিনের অনুসারীদের প্রতি সম্মানই দেখান। বরং জনতার দর্শনের জন্য লেনিন মুসোলিয়াম উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে এবং তা বিনা মূল্যে।
এবার অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে মস্কোতে ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ’ ১৫ থেকে ২১ অক্টোবর মহাসম্মেলন করেছে। এর অনুমোদন ও আয়োজনও রাশিয়ার আধুনিক বহুমুখী গণতন্ত্রের নবযাত্রার জয়ই ঘোষণা করে। রাশিয়ায় শতকরা আশি ভাগ রুশ ছাড়াও ঐতিহাসিকভাবে আছে তাতার, বাশকির, চুভাশ, চেচেন, ইউক্রেনিরা। আরও অন্যান্য জাতের কিছু মানুষ নানা সময় রাশিয়ায় গেছে। পুতিন সবাইকে নিয়ে তাঁর ‘নয়া রাশিয়া’ গঠনের ডাক দিয়েছেন। তিনি জোর দিয়েছেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ওপর এবং অবশ্যই তা ‘রুশ’ পরিচয়টি বিসর্জন না দিয়ে। ঐশ্বর্য প্রদর্শনের দিক থেকেও পুতিন বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে রাশিয়া পারে। বহু উচ্চ ভবনের সমন্বয়ে ‘মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর তাঁরই সময়, ২০১৬ সালে মস্কোতে স্থাপিত হয় ১ হাজার ২২৬ ফুট উচ্চতার ‘ফেডারেশন টাওয়ার’, যা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ভবন। উচ্চতার দিক থেকে ইউরোপের দ্বিতীয় আর তৃতীয় ভবনও রাশিয়ার, আর সে দুটোও পুতিনের সময় নির্মিত হয়েছে। ডজনে ডজনে চলছে দ্রুতগামী রকেট ট্রেন এবং সেখানে ভাড়া বেশি হলেও আসন শূন্য থাকছে না মোটেও। মানে রাশিয়ার মানুষের সামর্থ্য বাড়ছে। শপিং সেন্টারে কেনা, সেখানে লাঞ্চ বা ডিনার করা মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই।
সামর্থ্য বাড়ার আরেক প্রমাণ দেখা গেল আমেরিকার গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। ব্যাপারটি ভেতরে-ভেতরে কতটুকু গড়িয়েছিল এবং তা থেকে রাশিয়া আদৌ কী ও কতটুকু পেয়েছে বা পাবে, সে প্রশ্ন পরে। আপাতত সাধারণ রুশরা আমেরিকার ওপর ‘জিতে নিয়েছে’—এমন একটা ভাবে আছে। এই ভাবটি তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন ছিল। তবে সরকারি চাকরিতে বেতন আশানুরূপ বাড়েনি। মানুষ তাই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করছে। এই চ্যালেঞ্জ শুধুই ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, মানব সম্ভাবনার সীমা বাড়িয়ে দিয়ে এক থেকে একাধিক কর্ম করার আগ্রহ।
পুতিনের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার এক দশক পরের প্রজন্ম। সেই দশকের সন্তানেরা এখন চারদিকে। স্বেচ্ছাচারিতার যে পাঠ তারা সে সময় পেয়েছে, তা ছাড়তে পারছে না অনেকে। তাদের বাগে আনা খুব একটা সহজ নয়। তবে সাহিত্য–রচয়িতারা বা সংস্কৃতির কর্ণধারেরা স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রিত হয়েই চলছেন। তাঁদের সামনেও রাশিয়াকে দাঁড় করানোর স্বপ্ন। রুশরা বাসে, ট্রেনে, ট্রামে বসে উচ্চকণ্ঠে আড্ডা নয়, কাগজের বই বা ট্যাবে ধরে রাখা ই-বই পড়ছে। স্কুল-কলেজগুলোতে চলছে তাদেরই ঐতিহ্যকেন্দ্রিক লেখাপড়া। তবে কোনো কোনো স্কুলে ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। ‘জাগরণ ও সমন্বয়’ এই হলো ভ্লাদিমির পুতিনের আজকের রাশিয়ার মূলমন্ত্র। জাগরণ হলো রুশদের এবং সমন্বয় হলো নিজেদের বহুমতের। আজকের তরুণসমাজ পুতিনের ওপর খুবই আস্থা রাখে।
বুলেট ট্রেনে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে যাচ্ছিলাম মস্কোতে। পাশে বসা ষাটোর্ধ্ব একজন বললেন: ১৯১৭-তে এক ভ্লাদিমির আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, এখন আমাদের আছেন আরেক ভ্লাদিমির। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, তিনি লেনিন আর পুতিনের কথা বলছেন।
ড. সৌমিত্র শেখর: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
scpcdu@gmail.com