জাইরা ওয়াসিমের মনে হয়েছে, অভিনয় নয়, ধর্মচর্চাতেই তিনি শান্তি পাবেন। তাই অভিনয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি তাঁর ‘ফ্রিডম অব চয়েস’। কিন্তু একান্ত এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলিউড ও ভারতে নজিরবিহীন অসহিষ্ণুতা তৈরি করেছে। ব্যক্তিগতভাবে এই লেখকের ভাবনা এই যে জাইরা অতটা দ্রুততার সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত না নিলেও পারতেন। আরও কিছুদিন থেকে, আরও গভীর ভাবনাচিন্তা শেষে সিদ্ধান্তটি নিলে ভালো করতেন। কেন এই লেখকের এ রকম ব্যক্তিগত ভাবনা, সে কারণে পরে ফিরব। আগে মুম্বাইতে এ নিয়ে শুরু হওয়া তুলকালামের কী ব্যাখ্যা হতে পারে, সেদিকে আলোকপাত করা যাক।
বলা হলো জাইরার আইডি হ্যাক হয়েছে। একদল বলল তিনি অ্যাটেনশন-সিকার। আরেক দল বলল তাঁর অভিনীত মুক্তিপ্রত্যাশিত ‘স্কাই ইজ পিংক’-এর ব্যবসা বাড়ানোর প্রচারণার জন্য এই চালাকি করেছেন জাইরা। মুম্বাই চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টদের একদল প্রচারণা চালাল যে জাইরা ইন্ডাস্ট্রিটিকে হেয় করেছেন, ছোট করেছেন, প্রকারান্তরে নবীনদের নিরুৎসাহিত করেছেন। একদল আরও আগ বাড়িয়ে বলছে, সম্ভাবনাময় অনেক নতুন শিল্পী, বিশেষত প্রতিশ্রুতিশীল মুসলিম চলচ্চিত্রানুরাগীদের সুকৌশলে নিরুৎসাহিত করেছেন জাইরা। যেন জাইরা একধরনের প্রতিবিপ্লবে রত।
এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে দুই ধরনের তত্ত্বের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। এক পক্ষ বলতে চাইছে মুসলিম নারীদের কেউ বলিউডে প্রতিভা বিকাশের জন্য আসতে চাইলে বাবা-মা, অভিভাবকেরা জাইরার উদাহরণ তুলে তাদের নিরুৎসাহিত করবেন। অন্য দল সরাসরিই বলছে, মুসলিম শিল্পীদের মুম্বাইতে স্বাগত জানানোর আগে মুম্বাই–সংশ্লিষ্ট সবাই যেন সতর্ক থাকেন। যেন সাবধান থাকেন। রক্ষণশীল এই মতের অনেকেই বলছেন, অত মুসলিমপ্রীতি দেখানোর দরকার নেই। মুম্বাই যেন মুসলিমদের বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকে, যেন বেশি ভরসা না করেন মুসলিম কলাকুশলীদের ওপর।
জাইরাকে টুইট করতে হলো যে এসব অভিযোগের একটিও সত্য নয়; তাঁর আইডিও হ্যাকড হয়নি, অন্য সব অভিযোগও বানোয়াট। শুরু হলো জাইরাকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভর্ৎসনা-তিরস্কারের ঝড়। গুজব ছড়ানো হলো ধর্মোন্মাদ পরিবার ও কাশ্মীরি মুসলিম সমাজের জোরজবরদস্তিই জাইরাকে বলিউড ছাড়তে বাধ্য করেছে। আবারও জাইরাকে টুইট করতে হলো যে এসব অভিযোগের এক কানাকড়িও সত্য নয়। নতুন প্রোপাগান্ডা চলছে প্রমাণের জন্য যে তিনি জঙ্গিবাদ-সম্পৃক্ত। তারেক ফাতাহ, অনুপম খের তো বটেই, তসলিমা নাসরিনও লিখেছেন, তাঁদের সন্দেহ, জঙ্গিরা তাঁকে দিয়ে লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছে হয়তোবা।
তাঁদের কেন এমনটি মনে হয়েছে, তাঁদের হাতে মনে হওয়ার পক্ষে কী কী তথ্যপ্রমাণ আছে, তা অবশ্য কেউই দেখাতে বা জানাতে পারলেন না; জানানোর আগ্রহও দেখালেন না। টক শোগুলো দেখলে বোঝা যায়, ক্ষোভ, উষ্মা, বিরক্তি, ক্রোধে যেন একাকার অনেকেই। অনেকের আলোচনাতেই বিদ্বেষের অকুণ্ঠ প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত জাইরা এসবে ক্লান্ত। ক্রমেই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন; আত্মপক্ষ সমর্থনের বা নিজের অবস্থান ব্যাখ্যারও মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। উল্লেখ্য, জাইরার বয়স মাত্র ১৮। এই বয়সে তাঁর পক্ষে অনেক চাপ নেওয়া বা গুছানো অবস্থান নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
কিন্তু কেন এত প্রতিক্রিয়া? জাইরা কি সুপারস্টার? ছবি করেছেন মাত্র তিনটি, যার একটি এখনো মুক্তিই পায়নি। তাহলে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এমন কী বড় ক্ষতি হয়ে যাবে যে সিদ্ধান্তটি সবার এমন গা-জ্বলুনির কারণ হয়ে উঠতে পারে? যদি ধরেও নিই জাইরা বিশেষ প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, জাইরার আগে কি আর কোনো প্রতিশ্রুতিশীল কেউ মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছাড়েননি? তাঁদের বেলায়ও কি একই রকম সরব ছিল সবাই? সচরাচর দেখা যায় না এমন অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট স্বামী চক্রপাণি মুম্বাইয়ের হিন্দু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাঁরা যেন জাইরার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, ধর্মের রাস্তায় ফিরে আসেন।
মোদ্দাকথা, সব আলোচনার মূলে-অভিযোগে-ঊষ্মায় যে একটি বিষয়ই বিবিধ আকার-আকৃতিতে ঘুরেফিরে আসছে, তা হচ্ছে জাইরার ‘ইসলাম’–অনুরাগ এক গভীর সমস্যা, অসমাধানযোগ্য সমস্যা। জাইরার অনুপস্থিতিতে মুম্বাই কী হারাল, কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেই আলোচনাই কিন্তু হওয়ার কথা ছিল। অথচ তা মোটামুটি একেবারেই অনুপস্থিত বলা চলে। প্রশ্ন করা যেতে পারে অন্য কোনো ধর্মের কোনো প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেত্রী একই ধরনের ফেসবুক পোস্ট দিয়ে মুম্বাই ত্যাগ করলে একই রকম তোলপাড় হতো কি? আমার বিশ্বাস, না! হতো না!
সমাজবিজ্ঞানে ‘আইডেনটিটি’ বা ‘পরিচিতি’ বলে একটি শক্তিশালী সামাজিক ধারণা আছে। আমপাঠকের জন্য সহজ করে বলা চলে, কোনো না কোনো সময় মানুষ এই আত্মজিজ্ঞাসায় নামে যে ‘আমার জন্য কোন পরিচিতিটি আমাকে বেশি শান্তি দেবে’? যেমন জাইরার কথা ধরলে—তাঁর মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, ‘আমি কোন পরিচয়টিকে আমার জন্য বেশি শান্তির মনে করি?’ ভবিষ্যতের পথ নির্মাণের পথে কোন কোন ঘটনা বা ঘটনাপুঞ্জ আমাকে ভোগাচ্ছে, ভাবাচ্ছে, বাধা দিচ্ছে? সমাজমনোবিজ্ঞানের ‘স্টিম্যুল্যাস-রেসপন্স’ বা ‘উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া’ ধারণাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জাইরার সিদ্ধান্তও যে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ার সমষ্টিও হতে পারে, সেই আলোচনা কেউই করছে না। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মকে মূল বিষয় মনে হলেও তার ‘প্রতিক্রিয়া’কেও ধার্মিকতা বা ধর্মানুগামিতা মনে হতে পারে। পেছনের উদ্দীপকগুলোর আলোচনাও অনুপস্থিত।
‘থিসিস-অ্যান্টিথিসিস’ দ্বান্দ্বিকতায় পড়া ‘পরিচিতি-নির্মাণ’-এ অপরিহার্য। জাইরার হয়তো থিসিস ছিল—আমি শিল্পী, সৃজনশীল, উদ্ভাবক, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সমান। ধর্ম বরং আমার পরিচিতিকে সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্র একটি গণ্ডিতে ঠেলে দেবে। আমার একাগ্র ধ্যানজ্ঞান থাকবে শিল্পসত্তার দিকে। ঠিক তখনই অ্যান্টিথিসিস কাজ করা শুরু করল। জাইরার নজরে ভাসতে শুরু করল মোদি ক্ষমতায় এসেছেন। পুরুষদের প্রতি বিজেপির নারীনেত্রী আহ্বান জানালেন, মুসলমান নারীদের যেন প্রকাশ্য রাস্তায় গণধর্ষণ করা হয়। ঝাড়খন্ডে নেতা প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন, সম্পূর্ণ মুসলিমমুক্ত ভারত গড়া হবে। আসাম থেকে মুসলমানদের বের করে দেওয়া হচ্ছে মিথ্যা ‘বহিরাগত’ অজুহাতে। মুসলমান হওয়ার অপরাধ; গোমাংস ভক্ষণের ছুতোয় সত্য-মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগে যত্রতত্র মুসলমান নিবর্তন-নিধনের উসকানি চলছে মহামারি আকারে। প্রতিকারের চেষ্টার শতগুণ বেশি সেই উসকানি।
জাইরার চোখে ভেসে উঠল প্রিয় কাশ্মীর। রক্তে মাখামাখি শিশুসহ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মৃতদেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন যুবকদের মিলিটারি গাড়ির পেছনে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলার দৃশ্য। সীমাহীন বর্বরতা-নৃশংসতা ও অবিচারের ঘটনাপঞ্জি। সবকিছু ছাড়িয়ে হয়তো স্মরণে এসেছে কীর্তিমান শিল্পী শাবানা আজমি, আমির খান, নাসিরুদ্দিন শাহসহ অনেকের অসম্মান এবং সাম্প্রতিক মৌলবাদী হুমকিগুলো। বিজেপিপূর্ব মুম্বাইয়ে একটি আপেক্ষিক ধর্মপ্রভাবমুক্ত সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এবং ভারতজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চার সময়টি বর্তমান সময়টি থেকে একেবারেই ভিন্ন রকম ছিল বলা চলে। এর একটা কারণ ছিল, এই ইন্ডাস্ট্রির সূচনায় মুসলমান শিল্পী ও কলাকুশলীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বর্তমান সময়ের তীব্র মুসলিমবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদই ভারতের লাখ লাখ মুসলিমকে নিজেদের মুসলিম পরিচিতি নির্মাণে বাধ্য করবে। জাইরার অবস্থানকেও খুব ব্যতিক্রম মনে করার বিশেষ কারণ নেই।
জাইরার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জাইরার মতো প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিভাবান শিল্পীদের শিল্পচর্চায় নিবেদিত থাকাই মানবিকতা প্রতিষ্ঠায় বেশি কার্যকর। অভিজ্ঞতা ও ভাবনাচিন্তায় পরিণত হয়ে জাইরাও হয়ে উঠতে পারতেন সেলুলয়েডের অরুন্ধতী রায়। কাশ্মীর, মব-লিঞ্চিং, মুসলিমনিধনসহ অন্যান্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে মতামত গড়ে তুলতে পারতেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বা চলচ্চিত্রবোদ্ধার ভাষায়।
হেলাল মহিউদ্দীন: নৃবিজ্ঞানী,কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো