ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ

জল নিয়ে জলঘোলা আর নয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তিব্বতের মানুষের বিশ্বাস, হিমালয়ের চূড়ায় একসময় একটা হ্রদ ছিল। একজন বোধিসত্ত্ব (জ্ঞানী) ভাবলেন, মানবকল্যাণে হ্রদের জল জনপদে বয়ে যাওয়া দরকার। পর্বতের একটা জায়গা কেটে তিনি জলধারা উন্মুক্ত করে দিলেন। জন্ম নিল সাংপো। এর অর্থ হলো পবিত্রকারী। কেউ কেউ মনে করেন, এই জলধারা বয়ে গেছে স্বর্গের দিকে—সাংগ্রিলা। চীনা উচ্চারণে সাংপো হলো জাংবো।
চীনের ভূখণ্ড পেরিয়ে সাংপো ঢুকল ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে, এখন যে এলাকার নাম অরুণাচল। এখানে তৈরি হলো আরেক পুরাণ। ঋষি শান্তনুর স্ত্রী অমোঘা পৃথিবীর স্রষ্টা ব্রহ্মের দ্বারা সন্তানবতী হলেন। ছেলেসন্তান জন্ম নিল জলের আকারে। শান্তনু সন্তানকে কৈলাস, গন্ধমাদন, জারুধি এবং সম্বর্তক—এই চারটি পর্বতের মাঝে শুইয়ে দিলেন। ফলে তৈরি হলো বড় একটা হ্রদ, নাম ব্রহ্মকুণ্ড। পিতার আদেশে পরশুরাম কুঠার দিয়ে খুন করলেন নিজের মাকে। পাপমোচনের জন্য তাকে বলা হলো একটা পবিত্র স্থানে যেতে। পরশুরাম ব্রহ্মকুণ্ডের একটা ধার কেটে দিলেন। ফলে বের হলো জলধারা—ব্রহ্মপুত্র। কুঠারে লেগে থাকা রক্ত ব্রহ্মপুত্রের জলে ধুয়ে সাফ হলো, জল হলো লালচে। আসামের মানুষ ব্রহ্মপুত্রকে বলে লুইত (লোহিত), সংস্কৃত ভাষায় যা হলো রক্ত। কুপিয়ে জমি নরম করতে করতে (আবাদ করে) পরশুরামের ‘লাঙল’ সোনারগাঁ এসে ‘বন্ধ’ হলো (থামল)। ওই জায়গার নাম হলো লাঙ্গলবন্দ। এখন এটা পবিত্র তীর্থ। এই হলো ব্রহ্মপুত্র নদের জন্মকথা।
ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে ঢুকেছে কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে। বাহাদুরাবাদের কাছে এটা ময়মনসিংহ জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে ভৈরব অবধি, মিশেছে মেঘনার জলে। অপেক্ষাকৃত নতুন একটা জলধারা সোজা নেমে গেছে দক্ষিণে। এটাই এখন ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা, নাম যমুনা। আদি ব্রহ্মপুত্র এখন ক্ষীণকায়। ১২ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো একটা ছবি ও সংবাদ ছেপেছে। শিরোনাম—বর্জ্য ফেলে নদের সর্বনাশ। পবিত্র ব্রহ্মপুত্র এখন জামালপুর পৌরসভার ভাগাড়।
ব্রহ্মপুত্র মাঝেমধ্যে সংবাদ শিরোনাম হয়। ১৪ অক্টোবর ঢাকার কয়েকটি দৈনিক ভারতের একটি পত্রিকায় ছাপা সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, ব্রহ্মপুত্রে চীনারা জলবিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করেই ফেলেছে। বিদ্যুৎ শিগগিরই চীনের জাতীয় গ্রিডে যাবে। এ রকম প্রকল্প আরও হবে। কেউ কেউ আশঙ্কা জানিয়েছেন, এর ফলে ভাটির দেশে সমস্যা হবে, সমস্যায় পড়বে ভারত ও বাংলাদেশ।
ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর বড় নদীগুলোর একটি। এর দৈর্ঘ্য এবং আওতাধীন এলাকার পরিমাণ নিয়ে নানা রকমের হিসাব আছে। যে হিসাবটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, তাতে দেখা যায়, এই নদের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী এর অববাহিকা ৫ লাখ ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এই বিশাল এলাকার অর্ধেক (৫০ দশমিক ৫ শতাংশ) পড়েছে চীনে, ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ ভারতে, ৮ দশমিক ১ শতাংশ বাংলাদেশে এবং ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ভুটানে। ভারতে এই নদের অববাহিকায় আছে ছয়টি রাজ্য—অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম। বাংলাদেশের ৩৯ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মধ্যে। অর্থাৎ আমাদের দেশের চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি এলাকার মানুষ এই নদের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং বলা চলে, ব্রহ্মপুত্র নারাজ হলে এবং এর ওপর কোনো আঘাত এলে বাংলাদেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী বিপদে পড়বে, বিপর্যস্ত হবে।
ব্রহ্মপুত্র-বাহিত এলাকায় ৬২ কোটি মানুষের বাস। এত দিন এই নদের ৯৪ শতাংশ জল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে—নির্দ্বিধায়, নীরবে। আমরা এই বিপুল জলরাশি, এই বিশাল সম্পদের দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। এখন আমরা একটু নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছি। এই অঞ্চলের দুই বড় প্রতিবেশী—চীন ও ভারত এই নদের দিকে নজর দিয়েছে। চীন অনেক বছর ধরেই ব্রহ্মপুত্রের জল আটকে জলবিদ্যুৎ তৈরির আয়োজন করে আসছে। ভারত তার শুকনো এলাকাগুলো সবুজে ভরিয়ে দিতে ব্রহ্মপুত্রের জল নিয়ে আসার চিন্তা করছে। তৈরি হয়েছে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প। আমরা ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীন-ভারতের রশি টানাটানি দেখছি, অনেকটা তৃতীয় ছাগশিশুর মতো। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে আমরা এযাবৎ দুবার স্বাধীন হয়েছি, তবু গত সাত দশকে ব্রহ্মপুত্রের এক ফোঁটা জলও জনস্বার্থে ব্যবহার করার জন্য কোনো পরিকল্পনা হাতে নিইনি। এখন এই জলে ভাগীদারের থাবা পড়েছে। হয়তো আমরা খুব শিগগির হইচই শুরু করব, ব্রহ্মপুত্রের জলের ‘ন্যায্য হিস্যা চাই’।
ব্রহ্মপুত্র নদের জল থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা ৬৬ হাজার থেকে ২ লাখ মেগাওয়াট। ভারতে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ২ হাজার ১২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। নির্মাণাধীন আছে আরও ৫ হাজার ৫৯২ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র। চীনের পরিকল্পনায় আছে ৪০ হাজার মেগাওয়াট। এ ছাড়া চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি উত্তরাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবছে সেচ ও গৃহস্থালির প্রয়োজনে। ভারত তো আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েই রেখেছে। দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির থাবার নিচে বাংলাদেশ তার প্রয়োজনের পানিটুকু কীভাবে পাবে? অথচ পানির ওপর নির্ভর করছে প্রাণ—আবেহায়াত।
চীন এখন পর্যন্ত বলে আসছে যে পানি প্রত্যাহার করবে না। কিন্তু চীনের সঙ্গে পানিসম্পদ ভাগাভাগির কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা এই অববাহিকার অন্য কোনো দেশের নেই। যদি চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি সেচের জন্য ব্যবহার করে, তাহলে ভাটি এলাকায় পানির প্রবাহ কমে যাবে, যেমনটি হয়েছে পদ্মায়, তিস্তায় এবং এ রকম আরও অনেক নদীতে। যদি এমন অবস্থা সত্যি সত্যিই তৈরি হয়, তা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না।
ব্রহ্মপুত্রের পানিতে যদি চীন থাবা বসায়, তাহলে ভারত, বাংলাদেশ ও ভুটান—এই তিনটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য ব্রহ্মপুত্র নিয়ে এর অববাহিকার সবগুলো দেশের একসঙ্গে বসা দরকার, দরকার কথা বলা, একটা সমঝোতায় আসা। ভারত আর চীন দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিষয়টার একটা ফয়সালা তাদের নিজ নিজ স্বার্থে করে ফেললে বাংলাদেশকে পরে পস্তাতে হবে। প্রতিটি দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থেই প্রকল্প নেয়, অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি করে। বাংলাদেশকেও তাই জাতীয় স্বার্থেই নদী নিয়ে বহুপক্ষীয় আলোচনায় বসার তাগিদ দিতে হবে।
চীন ও ভারতের মধ্যে নানা বিষয়ে বিবাদ আছে। বাংলাদেশের এই বিবাদে জড়ানো মোটেও উচিত হবে না। এখানে চীন বড় বন্ধু না ভারত, তার চেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের স্বার্থের দিকে কার নজর কতটুকু। বাংলাদেশ নিয়ে নানা ক্ষেত্রে চীন-ভারতের দ্বৈরথ আছে। আমাদের উচিত হবে আমাদের স্বার্থে চীন ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই যত দূর সম্ভব দর-কষাকষি করা। একটা বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় এটা হলে ভালো হয়। আমরা গঙ্গা নিয়ে এটা চেষ্টা করেছিলাম, হয়নি। হিমালয়ের জলসম্পদ নিয়ে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার কথা আমরা অনেক বছর ধরে বলে আসছি। তাতে কাজের কাজ হয়নি।
চীন ও ভারত আগামী ৫০ কিংবা ১০০ বছর হিসাবে রেখে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘অ্যাডহক’। আজ যদি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আমাদের একটা বড় প্রকল্প থাকত, আমরা চীনকে বলতে পারতাম, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এত দিন ব্রহ্মপুত্রের পানি গোয়ালন্দ-চাঁদপুর হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। আমরা তা ব্যবহার করিনি। কিন্তু চিরদিন এমন থাকবে না। ব্রহ্মপুত্র দিয়েই আমরা বুঝতে পারব, চীন আমাদের কত কাছের বন্ধু। জল নিয়ে ভারতের সঙ্গে জল অনেক ঘোলা হয়েছে। এটা আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। ব্রহ্মপুত্র নিয়ে এখনই আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো গুছিয়ে চীনের সঙ্গে দরবার করা দরকার। ভারত সমমর্যাদার ভিত্তিতে সঙ্গে থাকলে ভালো হয়। পৃথিবীর অনেক দেশই এ ধরনের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমেই মিটমাট করেছে। আমরাও পারব। পারতেই হবে। তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com