গত বছরের শুরুতে গিয়েছিলাম রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ভাড়ারদহ বিল দেখতে। দেখলাম, সেটি সমতলভূমিতে পরিণত হয়েছে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গড্ডাঙ্গি নদী। অবৈধ দখলদারেরা সেই সমতল বিলে শর্ষে চাষ করেছিলেন। যাঁরা শর্ষে চাষ করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। একজন দখলদার বলেছিলেন, তাঁরা খাজনাও দেন। রিভারাইন পিপলের সিনেটর ও বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলী ফজলুল হক অবৈধ দখলদারের কবল থেকে বিলটি মুক্ত করেছেন। গত বছর সেই বিলের সংস্কারও করেছেন। পাড়ে শতাধিক প্রজাতির কয়েক হাজার গাছের চারা লাগিয়েছেন তিনি। সেই বিলে এখন হাজার হাজার পাখি আসে। দীর্ঘদিন অবৈধ দখলে থাকলেও বিলটি দখলমুক্ত ও সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে।
এই বিলের পাশেই আছে পাটোয়াকামরি বিল। সেই বিল যাতে সংস্কার করতে না পারেন, সে জন্য ওই বিলের অবৈধ দখলদারেরা সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরা প্রকৌশলী ফজলুল হককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। এই বিল দখলমুক্ত করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। তবে ফজলুল হক বলেন,Ñ প্রশাসনিক সহযোগিতা থাকলে এই বিল অবৈধ দখলমুক্ত করা সম্ভব।
নদী ছাড়াও আমাদের দেশে হাজার হাজার জলাভূমি আছে। শুধু সিলেট বিভাগেই তালিকাভুক্ত বিলের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। হাওরের সংখ্যা প্রায় ৪০০। সারা দেশে বিল ছাড়া অনেক জলাভূমি আছে। জলাভূমির কোনোগুলোর আয়তন কয়েক শ একর, আবার কোনোটির আয়তন এক একরের চেয়ে কম।
সারা দেশে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে জলাভূমি। পাহাড়ি, সমতল ও হাওর অঞ্চলভেদে জলাভূমির সামান্য কিছু পার্থক্য আছে। রংপুর জেলায় জলাভূমির সংখ্যা শতাধিক। রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতরেই আছে চিকলি ও দর্শনা নামের দুটি জলাভূমি। এর মধ্যে দর্শনা নামের জলাভূমিটি সম্পূর্ণ অবৈধ দখলে আর চিকলির সামান্য একটু অংশ অবশিষ্ট আছে। জলাভূমিগুলো রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের চরম উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। নদী নিয়ে বর্তমানে কিছু সংগঠন কাজ করলেও জলাভূমি নিয়ে কাজ করার মতো সাংগঠনিক কার্যক্রম তেমন চোখে পড়ে না।
জলাভূমিসহ প্রাকৃতিক সম্পদ পাবলিক ট্রাস্ট তথা জনগণের সম্পত্তি। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংবিধান দ্বারা এই দায়িত্ব অর্পিত। তিন বছর আগে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় দেওয়া হয়েছে। সেখানে নদী ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের কথাও বলা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, Ñ‘পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন ও বাতাস পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তিসমূহ ধ্বংসের যেকোনো পদক্ষেপ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী তথা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ ধারার পরিপন্থী।’
আমাদের জলাভূমিগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। কোনো কোনোটি অবৈধভাবে দখলদারেরা খেয়ে ফেলেছে, কোনোটির ওপরে সরকারি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কোনো কোনোটি ভরাট হয়েছে। আবার কোনোটি মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। যেগুলো ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে।
যে জলাভূমিগুলো বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি, সেগুলোতে অনেক পাখি দেখা যায়। রংপুরের পীরগঞ্জে বড়বিলার আয়তন প্রায় দেড় হাজার একর। এটি হাজার হাজার পাখির কলতানে মুখর থাকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ৭০০ একরের চরল বিলে হাজার হাজার পাখি দেখা যায়। এই বিল বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা চাষ করছেন, তাঁরা পাখির কথা ভাবছেন না। নওগাঁয় কয়েক শ একরের বড় একটি জলাভূমি আছে। এটির নাম জবই বিল। এখানে অগণিত পাখি আসে।
যেসব জলাভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি এবং ১২ মাস পানি থাকে। এসব জলাভূমিতে এখনো দেশি প্রজাতির মাছ আছে। যতগুলো জলমহাল বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সব কটিতে মাছ চাষ করার জন্য পানির ছোট ছোট পোকাও মেরে ফেলে বন্দোবস্তগ্রহীতারা। যখন বন্দোবস্ত শেষ হয়, তখন ওষুধ প্রয়োগ করে মাছ মারা হয়।
আমাদের জলাভূমিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ গঠন করা হয়েছে। এখনো এই অধিদপ্তরের জনবলকাঠামো, আইন এবং কাজের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। ১৯৪০ সালের সিএস নকশা অনুযায়ী জলাভূমিগুলোর সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। কীভাবে সারা বছর এগুলোতে পানি থাকবে, পাখির বসবাস উপযোগী করে তোলা যাবে, সেই কাজ করতে হবে এই অধিদপ্তরকে। শুধু পাখি কিংবা দেশি মাছ নয়, জলাভূমিতে যত প্রকার জীববৈচিত্র্য আছে, সেগুলো বাঁচিয়ে রাখার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় সহকারী ভূমি কমিশনাররা ভূমির দেখভাল করেন। তাঁদের দিয়ে জলাভূমি রক্ষা করা কঠিন। আজ পর্যন্ত দেশের যত জলাভূমি ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিটির সঙ্গে এই সহকারী ভূমি কমিশনাররা জড়িত। এখন অধিকাংশ জলাভূমি প্রভাবশালীদের হাতে। মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের সবচেয়ে ছোট কর্মকর্তা হিসেবে তাঁদের পক্ষে এগুলো উদ্ধার করা কঠিন। তাঁরা জলাভূমি যত সহজে ব্যক্তির নামে লিখে দিতে অভ্যস্ত, উদ্ধারে ততটা নয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কার্যাবলিতে জলাশয়ের কথা আছে। ২০১৩ সালের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনে কমিশনকে ১৩টি বিষয়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর শেষ নম্বরে বলা হয়েছেÑ ‘দেশের খাল, জলাশয় এবং সমুদ্র-উপকূল দখল ও দূষণমুক্ত রাখিবার বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করা।’ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রতিটি বিভাগের খাল-বিল ও জলাভূমি রক্ষার নিমিত্তে বিভাগীয় পর্যায়ে একটি করে কমিটিও গঠন করেছিল। রংপুর বিভাগীয় কমিটির আমি একজন সদস্য। মাত্র একটি সভা হয়েছিল ঢাকায়। এরপর কোভিড পরিস্থিতিতে আর কোনো কার্যক্রম লক্ষ করা যায়নি।
আমাদের জলাভূমি কেবল জলের আধার নয়, এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবেশের সম্পর্ক, আছে অগণিত জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর সম্পর্ক। তাই নিজেদের এবং উত্তর প্রজন্মের কথা ভেবে জলাভূমিগুলো রক্ষা করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক