জলবায়ু কূটনীতি ও সন্ত্রাসের বিরোধী যুদ্ধের মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ও সন্ত্রাসের বিপক্ষে সবাই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আজ কাবুলে বিস্ফোরণ তো দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলা তো অস্ট্রেলিয়া জ্বলছে দাবানলে। ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে সিডনির ক্রিকেট মাঠ।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধের সম্মেলনে মাদ্রিদে অবস্থান করছিলেন হাজার হাজার জলবায়ু পর্যটক। রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, এনজিও কর্মী, গবেষক, শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, বিক্ষোভকারী, ব্যবসায়ী; কে নেই এই সম্মেলনে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে বিশাল এই যজ্ঞের শুরু। গঠন করা হয়েছিল জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক কনভেনশন। ১৯৯৪ সাল থেকে ফি বছরই সম্মেলনে হচ্ছে। দিন দিন এর কর্মপরিধি বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সম্ভবত দীর্ঘ সময় ধরে চলা আন্তরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন। কিন্তু এরপরও দেশগুলো কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। গ্রেটা থুনবার্গের বৈশ্বিক ক্লাইমেট অ্যাকশনের জনপ্রিয়তার পর এবারও অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন।
প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। প্যারিস চুক্তিতে স্বেচ্ছা নিঃসরণ হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। তবে এটা বাধ্যতামূলক না। শুধু প্যারিস চুক্তিই না; এ রকম অনেক চুক্তির কথাই শুনেছি। কিয়োটো প্রটোকল, কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড, মারাক্কেশ অ্যাকর্ড, কানকুন অ্যাগ্রিমেন্ট, ডারবান প্ল্যাটফর্ম নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। বিশ্ব রক্ষায় যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে সব ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাবমতে, ২০১৯ সাল হচ্ছে ইতিহাসের সব থেকে উষ্ণতম বছর। এর আগে ছিল ২০১৮ সাল। এভাবে প্রতিবছরই নতুন করে উষ্ণতম বছরে পরিণত হচ্ছে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, চলতি বছরে আরব সাগরে শতাব্দীর সব থেকে বেশি ঝড়ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপসহ জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় দাবদাহ বয়ে গেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এক কোটি লোক অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ লাখই আবহাওয়াজনিত কারণে। বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা দুই কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। দেখা যাচ্ছে, আবহাওয়াজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়ার হার যুদ্ধবিগ্রহের থেকে বেশি।
পরিস্থিতির দাবি অনুসারে জরুরি ভিত্তিতে নিঃসরণ হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু নিঃসরণ হ্রাসের দায়িত্ব কে নেবে; শুরুর এই বিতর্ক ছাপিয়ে রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘ এক জটিল খেলায় জড়িয়ে পড়েছে। খেলা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বাধ্যতামূলক কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে না পারা রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা। রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এরাও রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আচরণ দেখে মনে হবে বেসরকারি সংস্থা, গবেষক, সুশীল সমাজের সদস্যরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষেই আছেন।
কিন্তু জলবায়ু রাজনীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এসব সংস্থা ও ব্যক্তি আদতে উন্নত বিশ্ব ও বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোর পক্ষেই কাজ করছে। উন্নয়নশীল ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থের পক্ষে এদের অবস্থান খুবই কম। অভিযোজন, সহিষ্ণুতা, ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা করে অযথাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হচ্ছে। অভিযোজন, সহিষ্ণুতা, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা প্রথম কাজ না। জরুরি হচ্ছে যেকোনো মূল্যে গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করা। এরপর পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোজন, সহিষ্ণুতা, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। জলবায়ু রাজনীতিতে ঘোড়ার আগেই গাড়ি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘোড়ার আগে এখন অনেক গাড়ি। সর্বশেষ ক্ষয়ক্ষতির জন্য বিমা পদ্ধতির আলাপ উঠেছে জলবায়ু কূটনীতিতে। এর সর্বাগ্রে রয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি থিংক ট্যাংক ও বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি বিমার অর্থ কে পরিশোধ করবে? রাষ্ট্র, না ব্যক্তি? আইলা বা সিডর আমাদের উপকূলে আবার আঘাত হানবে কি না, সেটা তো নিশ্চিত না। কিন্তু ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিমার অর্থ পরিশোধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতির জন্য আগাম অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই অর্থ ফেরত পাব। উন্নত বিশ্বের কর্মকাণ্ডের দায়ভারের জন্য উন্নয়নশীল বিশ্ব কেন বিমার অর্থ পরিশোধ করবে।
এর সঙ্গে আবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু সেবা নামের নতুন এক বিষয়। জলবায়ু বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে সেবা দিতে হবে। আগামী ১০ বছরে উত্তরবঙ্গে কতটুকু বৃষ্টি হবে বা খরা হবে, তা আগের তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্যতা নিরূপণ করা হবে। এ জন্য দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরকে উন্নত করতে হবে। অর্থ আসবে বিদেশ থেকে। এই অর্থ ঋণও হতে পারে। বিশেষজ্ঞও আসবেন বিদেশ থেকে। কিছু দেশি বিশেষজ্ঞও থাকবেন। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ মিলিয়ে সিংহভাগ অর্থই চলে যাবে বিশেষজ্ঞদের পকেটে। আর হাওরের কৃষক অকালবন্যায় ডুবে যাওয়া ধানখেতের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবেন। তখন কৃষককে বলা হবে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য বিমা করতে হবে। বিমার পক্ষে ওকালতি করছেন বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা। এরপর কৃষকের সেই ছবি জলবায়ু সম্মেলনে বড় করে দেখানো হবে। দেখানো হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কী হাল হয়েছে কৃষকের। বলা হবে বিমা করা জরুরি। বিমার লাভ-ক্ষতি নিরূপণের জন্য আবার সমীক্ষা, গবেষণার প্রয়োজন হবে। নতুন করে তহবিল জোগাড় হবে। উন্নত বিশ্ব ও বাণিজ্যিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে স্বীকৃতি পাবেন। এরপর নতুন কোনো বিষয়বস্তু সামনে আসবে। এভাবেই চলতে থাকবে জলবায়ু কূটনীতি।
দূর থেকে দেখে মনে হবে, বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে। কারও দম ফেলারও সময় নেই। সবাই খুবই ব্যতিব্যস্ত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একে অপরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কুতুবদিয়ায় ভাঙনের শিকার হয়ে যে কৃষক এখন ঢাকায় রিকশা চালান, গাবুরার যে মাছচাষি এখন ঢাকার বস্তিতে থাকেন, দিন শেষে তাঁদের প্রাপ্তির খাতায় বিশাল এক শূন্য। এই কৃষক, রিকশাচালকদের দেখিয়েই সরকারি কর্মকর্তারা বছর বছর জলবায়ু সম্মেলনে যাচ্ছেন। থিংক ট্যাংক, সুশীল সমাজের সদস্যরা গবেষণা, সমীক্ষা করার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের তহবিল জোগাড় করেন। কুতুবদিয়া বা দক্ষিণবঙ্গের গাবুরা নিয়ে শত শত গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। কিন্তু কুতুবদিয়া বা গাবুরার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভোলার ক্লাইমেট ভিকটিম তার বাড়িতেই আরামে ঘুমাতে চায়। ক্লাইমেট ভিকটিম হিসেবে ওয়ারশর পাঁচ তারকা হোটেল ঘুমিয়ে আরাম পায় না।
কার্যত জলবায়ু সম্মেলন এক বিশাল পর্যটন মেলায় পরিণত হয়েছে। এবারে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদলে ছিলেন ১৫০ জনের মতো। এর বাইরে বিভিন্ন এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে গেছেন শতাধিক। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ জনের মতো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। মাথাপিছু ৩ হাজার ৫০০ ডলার করে ব্যয় হলেও মোট খরচ হয়েছে ১০ লাখ ৫০ হাজার ডলার। টাকার হিসাবে কমবেশি ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বিমানে যাতায়াত বাবদ পরিবেশে ৮০০ মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড যুক্ত হতে অবদান রেখেছেন।
এভাবেই চলছে তামাশার জলবায়ু কূটনীতি। জলবায়ু পর্যটকেরা ফি বছর সম্মেলনের নামে মিলিত হন। অভিবাসন, সহিষ্ণুতা, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে গবেষণা, অনুসন্ধান, সমীক্ষা তৈরির জন্য তহবিল ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেন। কিছু বক্তৃতা হয়, ছেলে ভোলানো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলন তহবিল তৈরির খেলায় পরিণত হয়। এখান থেকে যে যেভাবে পারছেন আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। সরকারি, বেসরকারি সব পক্ষের লোকজন মিলেমিশেই জলবায়ু পর্যটন সম্মেলন উপভোগ করছেন। ব্যর্থতার দায়ভাগ কেউ নিচ্ছেন না।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।