ফসলচক্রের পরিবর্তন কি টের পাচ্ছেন? টের পাচ্ছেন প্রাণবৈচিত্র্যের পরিবর্তন? শেফালি ফুল কি সময়মতো ফুটছে? শীতের পাখি কি সময়মতো আসছে? শরৎ, হেমন্ত কি ঋতুচক্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে? বিশেষজ্ঞ না হয়েও টের পাচ্ছি তাপদাহ বাড়ছে। বাড়ছে শৈত্যপ্রবাহ, উষ্ণায়ন। সাগর-মহাসাগর উত্তপ্ত হচ্ছে, উপকূলে ঢুকে পড়ছে লোনা জল। ঘন ঘন আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা। এসব মোকাবিলা করতে ফি বছর জাতীয় আয়ের ২-৩ শতাংশ চলে যাচ্ছে। তারপরও দীর্ঘতর হচ্ছে জলবায়ু উদ্ধাস্তুদের মিছিল।
বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী দিচ্ছেন, কার্বন নিঃসরণ না কমালে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা আরও বাড়বে। তাঁদের কথা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ পুঁজিবাদী ভোগব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু সেই সতর্কবাণী উপেক্ষিত হয়েই চলেছে। কার্বন নিঃসরণ না কমে বেড়েই চলেছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হবে। কে শুনছে সে কথা? ১৯৯২ সালে গৃহীত জাতিসংঘ জলবায়ু সনদ শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোর অনেকেই মানছে না। ট্রাম্প মানেননি, অন্যদেরও না মানতে প্রলুব্ধ করেছেন। আশার কথা, ট্রাম্পের এই জলবায়ু অনীহা নীতি প্রথম কর্মদিবসেই বদলে দিয়ে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে গেছেন নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জলবায়ুবিজ্ঞানে তিনি বিশ্বাসী। তাই আশা করা যায়, বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। আমাদেরও প্রস্তুত হতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) অর্জনে সামনে রয়েছে মাত্র ৯ বছর। এসডিজির ১৭টি অভিষ্ঠের ১৩ নম্বর লক্ষ্য হলো জলবায়ু। প্যারিস চুক্তির অধীনে অভিযোজন ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন লক্ষ্য অর্জনের পথেও রয়েছে ৯ বছর। প্রশ্ন হলো, কেমন হবে এই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন? স্বাভাবিক উন্নয়ন থেকে কীভাবে এটি ভিন্ন? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে অভিযোজন সঠিকভাবে পরিমাপ করা এখনো কঠিন। তবে বিজ্ঞান এ পর্যন্ত অভিযোজনের তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করেছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলো মূল্যায়ন এবং যাচাই করে দেখা এমন কিছু আমরা করছি কি না। যদি করি, তাহলে তা বন্ধ করতে হবে। যেমন সুন্দরবনকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। কারণ, সুন্দরবন বাংলাদেশকে ঘূর্ণিঝড় থেকেই শুধু রক্ষা করে না, কার্বন শোষণও করে। তাই সুন্দরবন একই সঙ্গে জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন করে। পরিবেশ বিনাশী পদক্ষেপগুলো নেওয়া বন্ধ করতে হবে। পানি, বায়ু ও মাটির দূষণ ঠেকাতে হবে।
আমরা এখন অভিযোজনের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছি। দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো যেমন সেতু, রাস্তা, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ইত্যাদিতে বিনিয়োগের সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও আমাদের এখন বিবেচনা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনসহিষ্ণু হয়। সারা বিশ্বে সব বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখন বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও আমাদের তা বিবেচনা করতে হবে। যেমন জলবায়ু ঝুঁকি কমাতে ভালো হয়, যদি আমরা প্লাবন ভূমিতে ভাসমান ভবন নির্মাণ করি।
অভিযোজনের তৃতীয় পর্যায়টিকে রূপান্তরমূলক অভিযোজন বলা হয়, যা এখনো কিছুটা তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে। তেমন ভালো কোনো নজির এখনো নেই। কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলা নয়, বরং অভিযোজনব্যবস্থার ভালো ফল লাভের জন্যও এটি দরকার। তবে রূপান্তরমূলক অভিযোজন কেমন হতে পারে, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। উপকূলবর্তী জেলাগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষের অনিবার্য স্থানচ্যুতির বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের উপকূল থেকে দূরে এক ডজন শহরে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে এগুলো জলবায়ুসহিষ্ণু এবং অভিবাসীবান্ধব শহর হয়ে ওঠে। উপকূলীয় এলাকার ছেলেমেয়েদের এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা মাতা–পিতার মতো কৃষক বা জেলে না হয়ে শহুরে কাজে দক্ষ হয়ে ওঠে। এই কৌশল রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমাবে। এই মহানগরী আগামী দশকে আরও এক কোটি জলবায়ু অভিবাসীদের স্থান দিতে পারবে না।
জলবায়ু সনদের অর্থায়নে বাংলাদেশ ২০০৫ সালে জাতীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা (নাপা) প্রণয়ন করে। পরে স্বল্পোন্নত সব দেশ নাপা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করে। ২০১০ সালে নাপার ওপর ভিত্তি করে কানকুনে গৃহীত হয় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (নাপ)। নেপালসহ বেশ কিছু দেশ এ পরিকল্পনা তৈরি করে এরমধ্যেই বাস্তবায়নেও যাচ্ছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার পথনকশা তৈরি করে । জন–অংশগ্রহণের ভিত্তিতে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করা দরকার। তাহলে নভেম্বরে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে দলিলটি আমরা উপস্থাপন করতে পারব।
বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে ২০০৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) করে। দশ বছর পর এখন এটি জনঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা হালনাগাদ করা প্রয়োজন।
অভিযোজনকে আরও কার্যকর করার বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে কিছু শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। প্রথম শিক্ষাটি হচ্ছে, সত্যিকারের রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের জন্য এক দশক বা তারও বেশি সময় লাগবে। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত হবে না। বৈশ্বিক তহবিল যেমন গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা, যা শুধু প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে। তারা যদি রূপান্তরমূলক অভিযোজন কর্মসূচিতে সহায়তা দিতে চায়, তাহলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিভিত্তিক জাতীয় কর্মসূচিতে অর্থায়ন করতে হবে। দ্বিতীয় শিক্ষাটি হচ্ছে, সরকার ও সরকারের বাইরে বিশেষ করে বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারদের এই কাজে যুক্ত করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় শিক্ষা হলো রূপান্তরমূলক পরিবর্তন শুধু ছোট অঞ্চলে বা খাতে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, এর মাত্রা হবে দেশজুড়ে।
বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে ২০০৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) করে। দশ বছর পর এখন এটি জনঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। তাহলে ২০২১ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনায় একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন দেখতে পাবে। এটির মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন। সব জাতীয় পরিকল্পনার মূলধারায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিতে হবে। এসডিজিগুলোর সঙ্গে ডেল্টা প্ল্যান এবং দেশের ৮ম ও ৯ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনকে সংযুক্ত করে এ লক্ষ্য অর্জন করা দরকার।
এগারো বছর আগে বাংলাদেশ নিজস্ব বাজেটে জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। এ তহবিল থেকে ইতিমধ্যে তিন হাজার কোটি টাকার ওপর নানা জলবায়ু কর্মসূচিতে বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় জলবায়ু রেসিলিয়েন্ট ফান্ড তৈরি করেছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচি ও বরাদ্দ দিতে হবে। সবুজ জলবায়ু তহবিল বা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, অ্যাডাপটেশন ফান্ড, এলডিসি ফান্ড এবং অন্য বৈশ্বিক তহবিলগুলো থেকে অর্থায়ন পাওয়ার জন্য অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি প্রণয়ন ও পরিচালনার জন্য দক্ষতা ও সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি। জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা প্রয়োজন ধ্রুপদি গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম। গণবিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমফিল ও পিএইচডি কর্মসূচি অতিসত্ত্বর চালু করা দরকার।
এভাবেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি থেকে রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের মাধ্যমে সর্বাধিক সহিষ্ণু দেশে রূপান্তরিত হতে পারে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের মতো বাংলাদেশ তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনেও সামনের কাতারের দেশ হয়ে উঠবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে নেতৃত্ব দিতে পারবে।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী জলবায়ু, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘ কিয়োটো প্রোটোকলের যুগ্ম বাস্তবায়ন সুপারভাইজারি কমিটির সাবেক চেয়ার এবং জাতিসংঘ অ্যাডাপটেশন কমিটির সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান। quamrul2030@gmail.com