জর্ডানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা

জর্ডানের যুবরাজ হামজা বিন হুসেইন
জর্ডানের যুবরাজ হামজা বিন হুসেইন

বিবিসির ওয়েবসাইটে ৪ এপ্রিল জর্ডানের যুবরাজ হামজা বিন হুসেইনের একটি ভিডিও বার্তা শেয়ার করেছে, যাতে তাঁকে দৃশ্যত একটি ঘরে বসে বলতে শোনা গেছে, ‘১৫-২০ বছর ধরে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রশাসনযন্ত্রে যে চিড় ধরেছে এবং দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী নই।’ ক্ষমতাসীন ৫৯ বছর বয়সী বাদশাহ আবদুল্লাহকে উৎখাত করার চক্রান্ত করার অভিযোগে তাঁর সৎভাই ৪১ বছর বয়সী হামজাকে গৃহবন্দী করা হয়েছে মর্মে খবর বের হওয়ার পর হামজার ওই ভিডিওচিত্র প্রকাশিত হয়। এরপরই জল্পনা চলতে থাকে, আসলেই কি যুবরাজ হামজা বাদশাহ আবদুল্লাহকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্তে জড়িত ছিলেন? যদি সত্যিই সে ধরনের কিছু হয়ে থাকে, তাহলে জর্ডানের সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও বাইরের সেই সব দেশও তাতে উদ্বিগ্ন হবে যে দেশগুলো ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে জর্ডানের সম্পাদিত শান্তি চুক্তিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং যারা জর্ডানের ক্ষমতাসীন হাশেমিয়া রাজবংশকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করে।

আরব বসন্তের সময় জর্ডানও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে ছিল। এখনো অনেকে মনে করেন সিরিয়া ও ইরাকে যেভাবে সরকারবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটেছে জর্ডানে যদি সে ধরনের শক্তি মাথাচাড়া দেয়, তাহলে তার আঁচ ইসরায়েল ও সৌদি আরবেও পড়তে পারে। আর সেটি হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ জর্ডানের অন্য মিত্রদেশগুলোকে আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে।

জর্ডান অস্থিতিশীল হলে সৌদির গায়েও তার প্রভাব পড়বে—এটি জানা থাকার পরও মোহাম্মদ বিন সালমান সেই ঝুঁকি নিয়েছেন শুধু জর্ডানে ‘নিজের লোকদের’ বসানোর অভিলাষ থেকে

তবে সে ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রায় নেই। প্রিন্স হামজা সরকার উৎখাতের চক্রান্তের যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং ৫ এপ্রিল একটি বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘গত দুই দিনের যে ঘটনাপ্রবাহ তার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এবং মহামান্য বাদশাহর প্রতি আমার আনুগত্য রয়েছে।’

যেহেতু ২০০৪ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহ এক বিশেষ আদেশে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে পূর্বনির্ধারিত হামজার ক্রাউন প্রিন্স উপাধি বাতিল এবং সেখানে নিজের ছেলেকে স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন, সেহেতু হামজার এ বশ্যতা মেনে নেওয়ার (সেটি আন্তরিকভাবে হোক আর না হোক) বিবৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চেয়ে আরও ভয়ানক কিছু আছে। জর্ডানের পররাষ্ট্র ও উপপ্রধানমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, ‘নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রিন্স হামজা, শরিফ হাসান বিন জায়েদ ও বাসেম ইব্রাহিম আবদাল্লাহ ছাড়াও যাঁরা দেশের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সবার কার্যক্রম ও গতিবিধির ওপর নজরদারি করেছে।’ আবদাল্লাহ হলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং বিন জায়েদ রাজপরিবারের একজন সদস্য, যিনি একসময় সৌদি আরবে বাদশাহ আবদুল্লাহর দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এ দুজনও আছেন। সাফাদি বলেছেন, তাঁরা আটককৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা ছড়ানোর চক্রান্ত করার প্রমাণ পেয়েছেন। এদের সঙ্গে ‘বিদেশি শক্তিও’ আছে বলে সাফাদি দাবি করেছেন। এই বিদেশি শক্তি বলতে কোন দেশের কথা বলা হয়েছে, তা তিনি বা সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি, কিন্তু সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি আসলে সেই ‘বিদেশি শক্তি’ বলতে তিনি ইসরায়েলকে বুঝিয়েছেন। সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাদশাহ আবদুল্লাহর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সেই জায়গা থেকে অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েলের মিত্র সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানেরও এ অভ্যুত্থানচেষ্টার পেছনে হাত থাকতে পারে। মোহাম্মদ বিন সালমানকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে খলনায়ক হিসেবে দেখা হয়। হয়তো এ কারণেই জর্ডানের প্রিন্স হামজাকে গৃহবন্দী করার পরপরই মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে সমালোচনার বাইরে রাখতে বাদশাহ আবদুল্লাহর প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়ে দিয়েছেন।

ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ বলে পরিচিত মসজিদুল আকসার সম্মানিত খাদেম হিসেবে জর্ডানের ক্ষমতাসীন হাশেমি রাজবংশের পরিচিতি রয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমান ইসরায়েলের সঙ্গে এক হয়ে মসজিদুল আকসার অভিভাবকত্ব এই হাশেমি রাজবংশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায় বলে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে। বহু বিশ্লেষক মনে করেন, জর্ডান অস্থিতিশীল হলে সৌদির গায়েও তার প্রভাব পড়বে—এটি জানা থাকার পরও মোহাম্মদ বিন সালমান সেই ঝুঁকি নিয়েছেন শুধু জর্ডানে ‘নিজের লোকদের’ বসানোর অভিলাষ থেকে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জন অ্যান্ড্রুজদ্য ইকোনমিস্ট-এর সাবেক সম্পাদক