জর্জ বুশের নিষ্ঠুর ঠাট্টা–তামাশা

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, ২০০৩ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে আক্রমণ এবং অন্যান্য চমৎকারভাবে রক্তাক্ত পলায়নের জনক জর্জ ডব্লিউ বুশের সাম্প্রতিক গলদ সম্পর্কে সবাই এখন পর্যন্ত শুনেছেন। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ শুরু করা এবং সেখানে রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে পালিয়ে আসা অঘোষিত যুদ্ধাপরাধী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাম্প্রতিক একটি মুখ ফসকানো গলদ সম্পর্কে সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন।

সম্প্রতি টেক্সাসের ডালাসে নিজের প্রতিষ্ঠিত জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রেসিডেনশিয়াল সেন্টারে দেওয়া এক ভাষণে বুশ বলেছেন, ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ায় ‘জবাবদিহির অনুপস্থিতির’ কারণে সেখানকার ‘একজন মানুষ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ইরাকে অন্যায্য ও নৃশংস হামলা চালিয়েছেন।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, রাশিয়ার পুতিন অন্যায়ভাবে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছেন, কিন্তু মুখ ফসকে ইউক্রেনের স্থলে ‘ইরাক’ বেরিয়ে গেছে। তবে কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্রই তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং তৎক্ষণাৎ শুধরে নিয়ে বলেন, ‘আমি আসলে ইউক্রেনের কথা বলছি’। কথাটা বলেই তিনি কিছুটা বিড়বিড় করে বলেছেন, ‘এক অর্থে অবশ্য ইরাকেও (এমনটা হয়েছিল)।’

এই ‘পঁচাত্তরের’ বুড়ো বুশের ইরাক-ইউক্রেন গুলিয়ে ফেলার ঘটনা উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে বেশ হাসির উদ্রেক করেছিল। এই সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষা প্রতিবন্ধিতার সমস্যাটি নতুন নয়। তিনি এর আগেও তাঁর তথাকথিত ‘বুশইজম’সুলভ ভাষায় মানুষকে বিদ্রূপ করেছেন। ব্যাকরণগত ভুল বাক্যে কথা বলার অভ্যাস তাঁর নতুন কিছু নয়। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘দে মিসআন্ডারএস্টিমেটেড মি’ (শুদ্ধ বাক্য হবে: দে আন্ডারএস্টিমেটেড মি); একবার তিনি বলেছিলেন, ‘ইজ আওয়ার চিলড্রেন লার্নিং? (শুদ্ধ বাক্য: আর আওয়ার চিলড্রেন লার্নিং?)

কিন্তু কথা হচ্ছে, একটি জাতিকে ঠান্ডা মাথায় ধ্বংস করা মোটেও হাসি–তামাশার বিষয় নয়। ইরাকে লাখ লাখ মানুষ মেরে, সেখানে রীতিমতো গণহত্যা চালিয়ে, সেখানকার মানুষকে ভিটেছাড়া করে ও সেখানে তেজস্ক্রিয় বোমা ফেলে অনাগত প্রজন্মকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার জন্য যে মানুষটি দায়ী, সেই লোকটিই যখন তাঁর অপকর্মের দুই দশক পর ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলেন, ‘ইরাকেও, কোনো না কোনোভাবে এটা হয়েছে’, তখন আর সেটি মোটেও হাসির বিষয় থাকে না।

কল্পনা করুন, একজন অশ্বেতাঙ্গ বা অপশ্চিমা কেউ যদি নাইন–ইলেভেন হামলা নিয়ে এ ধরনের কিছু মুখ ফসকে বলতেন এবং তারপরই ঠাট্টার ছলে কৌতুককর কিছু বলে ফেলতেন, তাহলে পশ্চিমা সমাজে কী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতো। অন্যদিকে বুশ এবং তাঁর অনুষ্ঠানে আগত শ্রোতারা অশ্বেতাঙ্গ ও অপশ্চিমাদের গণহত্যার উল্লেখকে রীতিমতো হাস্যরসের বিষয় বানিয়ে ফেলেছেন।

২০০৬ সালে জি-৮ সম্মেলনে বুশ ও ব্লেয়ারের এ ধরনের নিষ্ঠুর ঠাট্টা–তামাশা আমরা দেখেছি। লেবাননে টানা ৩৪ দিন ইসরায়েল বোমাবর্ষণ করে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করার পর ওই সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে বুশ ও ব্লেয়ার নিষ্ঠুরভাবে হাসাহাসি করেছিলেন। নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করেছিলেন। ব্লেয়ার তাঁর ‘নিজের হাতে বোনা’ একটি সোয়েটার বুশকে উপহার দিয়েছিলেন।

এ ধরনের হালকা কথাবার্তা যথার্থ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বুশ এর আগেও বলেছেন। ২০০৬ সালে সিবিএস ইভিনিং নিউজের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বুশ বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন, ইরাক যুদ্ধে আমার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে ইরাককে যুক্ত করে দেওয়া।’ ইরাক যুদ্ধ নিয়ে তিনি এর চেয়ে বড় ঠাট্টা করেছিলেন ২০০৪ সালে। ‘হোয়াইট হাউস করেসপন্ডেন্টস ডিনার’ নামে হোয়াইট হাউসে প্রতিবছর ঐতিহ্যগতভাবে সাংবাদিকদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ২০০৪ সালের ওই নৈশভোজে স্লাইড শো ছিল। বড় টিভি পর্দায় এক একটা স্লাইডে ছবি দেখানো হচ্ছিল। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছিল প্রেসিডেন্ট বুশ ওভাল অফিসে ফার্নিচারের নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই স্লাইড প্রদর্শনের সময় নিজের ছবির দিকে চেয়ে বুশ আগত অতিথিদের ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘(ইরাকের) গণবিধ্বংসী অস্ত্র (উইপেনস অব ম্যাস ডেসট্রাকশনস, সংক্ষেপে ‘ডব্লিউএমডি’) এই টেবিলের নিচেই আছে হয়তো!’ বলেই তিনি ফিক ফিক করে হাসছিলেন।

মাথায় রাখুন, তিনি এসব বলছিলেন ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পরে। এই যুদ্ধ বুশ শুরু করেছিলেন ইরাকের হাতে থাকা কথিত ডব্লিউএমডির হাত থেকে গোটা বিশ্বকে রক্ষা করার নামে। দ্য নেশন পত্রিকা ২০০৪ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ওই পত্রিকার সম্পাদক ডেভিড কর্ন ‘লাফিং উইথ বুশ’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বুশ ওই অনুষ্ঠানের গোটা পরিস্থিতিটাই বুশ ঠাট্টা–তামাশায় পরিণত করেছিলেন।

২০০৬ সালে জি-৮ সম্মেলনে বুশ ও ব্লেয়ারের এ ধরনের নিষ্ঠুর ঠাট্টা–তামাশা আমরা দেখেছি। লেবাননে টানা ৩৪ দিন ইসরায়েল বোমাবর্ষণ করে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করার পর ওই সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে বুশ ও ব্লেয়ার নিষ্ঠুরভাবে হাসাহাসি করেছিলেন। নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করেছিলেন। ব্লেয়ার তাঁর ‘নিজের হাতে বোনা’ একটি সোয়েটার বুশকে উপহার দিয়েছিলেন। এরপর সেখানে বুশ তাঁর ভাষণে বললেন, ইসরায়েলকে বোমা বর্ষণ বন্ধ করতে বলে লেবাননে রক্তপাত বন্ধ করা যাবে না, তার বদলে লেবাননের হিজবুল্লাহকে প্রতি আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।

সেই বুশ ইউক্রেনে অন্যায় ও নৃশংস যুদ্ধ হচ্ছে বলতে গিয়ে ইরাকের নাম বলে ফেলেছেন। সেই ভুল শুধরে নেওয়ার ভাষার মধ্যেও তিনি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

বেলেন ফার্নান্দেজ জ্যাকবিন ম্যাগাজিনের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর