মতামত

জমি দখল যখন সাংসদের ‘ব্যক্তিগত’ বিষয়

‘হাওর বাংলা’ বাড়ির সামনে আলতু মিয়া
ছবি: খলিল রহমান


সাংসদ হলে সম্পদ বাড়ে, এটা আমরা জানি। সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনেরও বেড়েছে। তিনি সুনামগঞ্জ-১ আসনের (ধরমপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ) সাংসদ। টানা ১২ বছর ধরে সাংসদ তিনি। ২০০৮ সালে প্রথমবার তিনি যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন, তখন তাঁর নিজের গ্রাম ধরমপাশা উপজেলার নওধারে একটি টিনশেড বাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেটাও পিতার কাছ থেকে পাওয়া।

তিন মেয়াদের এই সাংসদ এখন নিজের গ্রাম, উপজেলা ও জেলায় তিন-তিনটি বাড়ির মালিক। ঢাকার গুলশানে রয়েছে ফ্ল্যাট। মালিক হয়েছেন দুটি গাড়ির। আগের তুলনায় কৃষিজমি বেড়েছে ৫২৩ একর, অকৃষি জমি বেড়েছে ৮ একরের বেশি। এগুলো ঘোষিত সম্পদ। এর বাইরে তাঁর সম্পদের আরও যে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলোকে অবশ্য এখন পর্যন্ত অভিযোগ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। কানাডায় বাড়ি কেনা ও বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচার, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ—এসব অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন এই সাংসদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। দুদকের তদন্তের যেহেতু নিষ্পত্তি হয়নি, তাই তিনি কানাডায় বাড়ি কিনেছেন কি না বা কত শত কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করেছেন বা বিদেশে পাচার করেছেন, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।

তবে দুদক যে ধরনের প্রতিষ্ঠান তাতে সরকারি দলের কোনো সাংসদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ঠিকঠাক তদন্ত হবে, এমন ভরসা কেন জানি জনগণ পায় না। জনগণ দেখে ও শোনে, সাংসদের বিদেশে জেল-জরিমানা হয়, কিন্তু দুদক কিছু ধরতে পারে না। অনেকের ভাষায় দুদক হচ্ছে এমন এক বাঘ, যার দাঁত নেই। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চও সেদিন সুইস ব্যাংকসহ বিদেশি ব্যাংকে জমা টাকা ফিরিয়ে আনতে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের শুনানির সময় বলেছেন, ‘দুদককে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দন্তহীন বাঘের মতো আচরণ করলে চলবে না।’ দুদক তার আচরণ কতটুকু পাল্টাবে কে জানে!

সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিষয়ে দুদকের ওপর ভরসা না করে আমরা বরং কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তি কাজে লাগাই। কানাডায় বাড়ি, বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচার—এসব অভিযোগ পাশে রেখে আমরা ১২ বছরে তাঁর সম্পদ বৃদ্ধির মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দেখতে পারি। আমরা ভেবে দেখতে পারি, তিনি কী এমন জাদুর কাঠি পেয়েছেন, যার ঘষায় এই সময়ে তিন-তিনটি বাড়ি ও ঢাকার গুলশানে ফ্ল্যাট কেনা যায়, প্রায় ৫৩০ একর জমি বাড়ানো যায় ও দু–দুটি গাড়ির মালিক হওয়া যায়!

আমরা ভেবে দেখতে পারি, তিনি কী এমন জাদুর কাঠি পেয়েছেন, যার ঘষায় এই সময়ে তিন-তিনটি বাড়ি ও ঢাকার গুলশানে ফ্ল্যাট কেনা যায়, প্রায় ৫৩০ একর জমি বাড়ানো যায় ও দু–দুটি গাড়ির মালিক হওয়া যায়!

সাংসদ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ হতে পারে। সেটি তদন্ত করে দেখবে দুদক। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার সম্পদের হিসাব পরিষ্কার। সব হিসাব আমার আয়কর ফাইলে উল্লেখ আছে। বিদেশে কোনো বাড়ি নেই। টাকাও পাচার করিনি।’

দুদকের ওপর আমাদের ভরসা যত কমই হোক, সাংসদের ভরসা যে প্রবল, তা আমরা বুঝতে পারছি। তিনি হয়তো অনেকটাই নিশ্চিত যে দুদকের ‘পরীক্ষায়’ তিনি সহজেই পাস করে যাবেন। কিন্তু পাঠকের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে আপনার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান কী বলে?

‘হাওর বাংলা’ এক আলিশান বাড়ি। সাংসদ এটি বানিয়েছেন তাঁর নিজের গ্রামে। এখানেও তাঁর বিরুদ্ধে আছে জমি দখলের অভিযোগ। সাংসদের বিরুদ্ধে যে দুজন জমি দখলের অভিযোগ করেছেন তাঁরা বাস্তব চরিত্র—পাশাপাশি গ্রামের আলতু মিয়া ও বিকাশ রঞ্জন সরকার। আলতু মিয়ার ছবি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়। তিনি ‘হাওর বাংলা’ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দখল করা জায়গা দেখাচ্ছেন। বিকাশ রঞ্জনের অভিযোগ, সাংসদ টাকা না দিয়ে তাঁর জমি নিজের করে নিয়েছেন। আমরা ভেবে দেখতে পারি, এই দুজনের অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু? একজন সরকারি দলের সাংসদের বিরুদ্ধে তাঁরই এলাকার দুজন ‘মিথ্যা’ অভিযোগ করবেন—আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা কতটা সম্ভব?

আলতু মিয়ার অসহায়ত্ব আমরা অসহায়ের মতো শুধু অনুভব করতে পারি, ‘আমি জমি ফিরে পাওয়ার জন্য ঘুরতে ঘুরতে নিঃস্ব হয়ে গেছি। সবাই বিষয়টি জানে। কিন্তু কেউ কোনো সহায়তা করতে পারে না।’ প্রথম আলো যখন সাংসদের কাছে এই জমি দখলের কথা জানতে চেয়েছে তখন তিনি ‘আলতু-ফালতু’ কাউকে চিনতেই পারেননি। বিকাশ রঞ্জনকে অবশ্য সাংসদ চিনতে পেরেছেন এবং ‘নিজের লোক’ হিসেবে ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছেন। জমি নিয়ে বিকাশ রঞ্জনের অভিযোগ সম্পর্কে সাংসদের জবাব হচ্ছে, ‘এটা একেবারে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’

বিকাশ রঞ্জন অবশ্য জমি দখলের বিষয়টিকে ‘ব্যক্তিগত’ মনে করছেন না। কারণ তিনি সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন প্রকাশ্যে। কিন্তু তাতে কি কিছু আসবে যাবে? আলতু বা বিকাশ তাঁদের অভিযোগের প্রতিকার পাবেন, সেই আশা কি আমরা করতে পারি? নাকি বিষয়টি ‘ব্যক্তিগতই’ থেকে যাবে?

এসব গুরুতর প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ থাক। আমরা বরং এ থেকে কিছুটা বিনোদন খুঁজে নিই, নতুন কিছু শিখি, ‘জমি দখল একটি ব্যক্তিগত বিষয়’।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
akm.zakaria@prothomalo.com