মতামত

জনশুমারি ও গৃহগণনা সফল করতে যা করা দরকার

‘জনশুমারিতে তথ্য দিন, পরিকল্পিত উন্নয়নে অংশ নিন’ স্লোগানকে উপজীব্য করে দেশে এখন ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৪ জুন রাত থেকে ২১ জুন ২০২২ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এটি দেশের প্রথম ডিজিটাল শুমারি, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও একটি মাইলফলক। ১০ বছর অন্তর হিসাবে ২০২১ সালে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার কারণে, বিশেষ করে করোনা মহামারি ও ট্যাব কেনার জটিলতায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। করোনা মহামারি-উত্তর সময়ে আমাদের হাতে জনসংখ্যা ও এ-সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক গৃহস্থালির হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই। সর্বশেষ শুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। ফলে এ মুহূর্তে আমাদের হাতে জনসংখ্যার যে তথ্য রয়েছে, তা প্রাক্কলিত।

শুমারিতে জনমিতিক (জন্ম, মৃত্যু, স্থানান্তর, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক; বয়স, লিঙ্গ/জেন্ডার, জাতীয়তা, বৈবাহিক অবস্থা, প্রতিবন্ধী কি না), আর্থসামাজিক (শিক্ষাগত অবস্থান, ধর্ম, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগত অবস্থান, আর্থিক কর্মকাণ্ড, কাজের ধরন, মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার, ব্যাংক হিসাব আছে কি না ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য), এবং বাসগৃহ (বসবাসের ধরন, মালিকানা, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন) সম্পর্কে সঠিক তথ্যের কোনো বিকল্প নেই। ফলে এ শুমারির গুরুত্বও অনেক বেশি। শুমারির মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যা নিরূপণ-আর্থসামাজিক ও জনমিতিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ সম্ভব।

বর্তমান শুমারি আয়োজনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা দুই–ই রয়েছে। সব মানুষকে গণনায় আনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে? তা যথার্থ কি না? এর উত্তর কেবল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোই (বিবিএস) সঠিকভাবে বলতে পারবে। আশা করছি, প্রস্তুতি অনুযায়ী শুমারির কাজ চলছে, যা ২১ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সম্পাদনে নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এবং তা অতীত থেকে ভিন্ন। দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল শুমারি হতে যাচ্ছে। আবার বিদেশিদের গণনায় এবং দেশের বাইরে যাঁরা গেছেন, তাঁদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে যেন নির্ভুল শুমারি হয়, তার নির্মোহ পর্যালোচনা প্রয়োজন। কারণ, এ শুমারির তথ্য দিয়ে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হবে, তথ্যে ভুল থাকলে পরিকল্পনা হবে বাধাগ্রস্ত। খানাগণনার সময় সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, দেশের মানুষ কর্মসূত্রে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। আমি বলব পপুলেশন মবিলিটি (জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর) বেড়েছে। ফলে মানুষকে শুমারিকালে খানায় অবস্থানে উৎসাহিত করতে হবে। তা ছাড়া বর্ষাকাল ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ে এ শুমারি আয়োজন বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সিলেট অঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে শুমারি কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে ওই অঞ্চলে।

শুমারি আয়োজন অনেক ব্যয়বহুল হলেও এটি সর্বশেষ অধিকতর কিংবা নির্ভুল জনসংখ্যার উপাত্ত প্রদান করে, জনসংখ্যার উপাত্ত ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা দেয়। জনসংখ্যার উপগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য দেয়। তবে শুমারি সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে কাজটি কেমনভাবে সম্পাদন করা হচ্ছে। ডিজিটাল জনশুমারি বাস্তবায়নে দেশের সব নাগরিকের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ করতে হবে। কেননা, উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য তথ্য-উপাত্ত দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, বিশেষ করে সরকারের অষ্টম ও নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সূচকের অগ্রগতি নির্ধারণে সহায়ক হবে।

একটি সফল শুমারি নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংকলন এবং তা প্রকাশের ওপর। এ প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু শুমারি আয়োজনে বেশ কিছু করণীয় আছে। প্রথমত, গুণগত মান নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন স্তর বা এলাকাভিত্তিক তদারকি কার্যক্রম জোরদার করা। প্রশিক্ষিত তথ্য সংগ্রহকারী, সব পর্যায়ে মনিটরিং টিম গঠন, যাঁরা তথ্য প্রদান করবেন তাঁদের মধ্যে গণনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চাহিদা সৃষ্টিতে সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় বা কমিউনিটি পর্যায়ের ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধকরণ। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল ম্যাপভিত্তিক পরিবীক্ষণ, তথ্যের সঠিক সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে ব্যবহৃত ট্যাবলেটগুলো থেকে সংগৃহীত তথ্য ডেটা সার্ভারে সংযুক্তিতে যেকোনো বাধা অপসারণ। নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার, মুঠোফোন ডিভাইস সফটওয়্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তৃতীয়ত, সবার অংশগ্রহণ, কেউবা কোনো খানা যাতে বাদ না পড়ে, ভূমিহীন, ভাসমান জনগোষ্ঠী, ট্রান্সজেন্ডার, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বস্তিবাসীদের দিকে বিশেষ মনোযোগ প্রদান, যাতে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। চতুর্থত, লক্ষ রাখতে হবে, এবার যেহেতু বিদেশিদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, ফলে সুশিক্ষিত ও দক্ষ গণনাকারী নিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চমত, মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার করা, জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। শুমারি চলাকালে প্রতিমুহূর্তে দরকার ব্যাপক প্রচারণা, যাতে সবাই অংশগ্রহণ করে। মনে রাখতে হবে, সব মানুষকে গণনায় আনা কঠিন, কিন্তু আনতে হবে। নাগরিক হিসেবে সবারই দায়বদ্ধতা আছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মিডিয়াগুলোও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা নিজেরাই এ-সংক্রান্ত সংবাদ ও প্রচারণা চালাতে পারে। ষষ্ঠত, যেহেতু ডিজিটাল শুমারি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ফলে অতি দ্রুত শুমারি-উত্তর যাচাই জরিপ, আর্থসামাজিক ও জনতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করা। দ্রুত শুমারির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ এবং সর্বসাধারণের জন্য তথ্য উন্মুক্ত ও স্বচ্ছতা আনতে হবে। এ কাজগুলো একত্রে করা সম্ভব হলেই কেবল শুমারি ও গৃহগণনা সফল হয়েছে বলে পরিগণিত হবে।

ফলে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অধিকতর ফলপ্রসূ ও সফল করার লক্ষ্যে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ জনশুমারি বাস্তবায়নের জন্য সর্বস্তরে যোগাযোগ, সমন্বয়, তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ত্রুটিমুক্ত ও সফল শুমারি করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের সবাইকে যার যার পরিসরে দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিতে হবে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

mainul@du.ac.bd