গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচনই হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া অথবা থাকার একমাত্র উপায়। নির্বাচন স্বচ্ছ হলে, সুষ্ঠু হলে, গণতন্ত্র সংহত হয়, সুশাসন নিশ্চিত হয়, সরকারব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বাড়ে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে মানুষের আস্থা হারিয়ে যায়। স্বচ্ছ নির্বাচন তাই গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত।
দুঃখজনকভাবে ১৯৯১ থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রচর্চায় নির্বাচন অস্বস্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে নিয়ে স্থানীয় নির্বাচন—কোনোটিতেই স্বচ্ছতা থাকে না, ফল নিয়ে অসন্তোষ থাকে। নির্বাচন বর্জন হয়, ভোটাভুটির মাঝখানেই বড় দলের প্রার্থী সরে দাঁড়ান। বিজয়ী দলের কাছে নির্বাচন হয় অতি উত্তম, দক্ষিণ এশিয়ার মডেল, পরাজিত দলের কাছে তামাশা, অথবা চরদখলের মহড়া। আমাদের দেশের নির্বাচনী অভিধানে বেশ কিছু শব্দবন্ধ উপহার দিয়েছে এই আড়াই দশকের যত নির্বাচন, যেমন সূক্ষ্ম কারচুপি, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি। সম্প্রতি নির্বাচনে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা অথবা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও তোলা হচ্ছে।
এসব অভিযোগের ভিত্তি কতটা আছে, কতটা নেই, তা দলগুলোর চেয়ে ভোটাররাই ভালো জানেন। আমাদের দেশের ভোটাররা এখন অনেক সচেতন। কোথায় কারচুপি হয়েছে, কোথায় হয়নি, তাঁরা তা জানেন। কিন্তু তাঁদের আলাদাভাবে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ করার উপায় নেই। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত থাকে তাদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে। জনগণকে তারা ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের সুখ-দুঃখের পাশে দাঁড়ায় না।
আমাদের দেশে নির্বাচনব্যবস্থা সুষ্ঠু না হওয়ার একটি কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতায় গণতন্ত্রের অভাব। গণতন্ত্র তাদের জন্য ঠোঁটসেবার একটি বিষয়। প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রেমী হলে দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা হতো। তৃণমূলের মতামত দলগুলোর ভেতরের নির্বাচনে প্রতিফলিত হতো। আমরা আক্ষেপ করি, ভালো মানুষেরা রাজনীতিতে আসেন না। ভালো মানুষেরা আসেন না, যেহেতু তঁারা পেশিশক্তিতে বিশ্বাস করেন না, জোর যার মুল্লুক তার—এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। ভালো মানুষ সৎ পথে পয়সা উপার্জন করেন। এ জন্য দেশের রাজনীতির দরজা তঁাদের জন্য বন্ধ। তারপরও রাজনীতিতে ভালো মানুষ অবশ্যই আছেন এবং তাঁদের জন্য এখনো মানুষের কথাগুলো কিছুটা হলেও ক্ষমতার কানে যায়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে এ কারণে যে মূল দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্যাডার বাহিনী নেই; তাঁদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ, তাঁরা মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চেয়েছেন। মানুষ যাঁকে অধিকতর যোগ্য ভেবেছে, তাঁকে জয়ী করেছে। এর বিপরীতে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দুটি বড় দল মাঠে সক্রিয় ছিল। দুই দলের নেতারা যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতে মানুষ খুব স্বস্তি পায়নি। ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে হামলা হয়েছে। দলের ক্যাডাররা ব্যালটে সিল মেরেছে। কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট বাধা দিলে ওপরমহল থেকে টেলিফোন করে তাঁকে বাণী শোনানো হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট চোখে পানি নিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন সাংবাদিকদের। এ রকম ঘটনা খুব যে ঘটেছে, তা নয়; কিন্তু একটি ঘটনাও তো মানা যায় না। আমরা যে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতার কথা বলি, নির্বাচনে অনিয়মের ক্ষেত্রে সেটাই তো সব বিবেচনার আগে থাকা উচিত।
আমাদের দেশে যত দিন দলগুলো নির্বাচন নিয়ে একটি অলিখিত চুক্তিতে না আসবে, যাতে থাকবে গণতন্ত্রের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার প্রকাশ, তত দিন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। আর যদি চুক্তিটি বলবৎ হয়, তাহলে কোনো দলীয় সরকার যদি নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকে, তাহলে সেই দলের প্রার্থী হেরে গেলেও বলবেন, স্বচ্ছ নির্বাচনের রায় মেনে নিচ্ছি।
দলগুলো তৈরি না হলে সে রকম কোনো চুক্তির সম্ভাবনা যে নেই, তা তো বলেই দেওয়া যায়।
২.
নির্বাচন যদি মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রতি যেমন সরকার, সরকার ও সরকারের বাইরের সব প্রতিষ্ঠান সম্মান দেখাবে, তাঁরাও সেই সম্মান এদের প্রতি দেখাবেন, গণতন্ত্রের এটিও একটি শর্ত। জনপ্রতিনিধিরা বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হলে তাঁদের কাজের জায়গাটা বাধামুক্ত রাখতে হবে, তাঁদের প্রতি সরকার ও সরকারি দলের বৈরী আচরণ করলে চলবে না; সরকারি দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবেন, সেসব তাঁরাও ভোগ করবেন।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে কম আসন পেয়ে একটি দল বিরোধী দলের আসনে বসলে তার সাংসদদেরও কিছু দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়। উন্নত গণতন্ত্রের দেশে একটি ছায়া সরকার থাকে, যাতে সরকারের কাজকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায়, সরকারের ভুলভ্রান্তি দেখিয়ে দেওয়া যায়, ভুলভ্রান্তি বড়সড় হলে এবং সেগুলো দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেগুলো শোধরানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। বিরোধী দল গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি এ রকম সক্রিয়তা বজায় রাখলে সরকার অনেক সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। আমাদের দেশে এসব কিছুই হয় না।
বিরোধী দলকে এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয় না। তাদের জনসভা করারও অনুমতি থাকে না। গত সাত-আট বছরে সরকার বিএনপিকে এমন কোণঠাসা করে রেখেছে যে তারা সংগঠিত হওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে না। গত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করার পথে নামায় এবং এরপর সহিংসতার আশ্রয় নেওয়ায় দলটি অনেকটা জায়গা হারিয়েছে। যে জন্য রামপালের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে তাদের পথে দেখা যায়নি। সংসদে না থাকায় রাজপথটাও মোটামুটি দলটি হারিয়েছে। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে রামপাল থেকে সরকার পিছিয়ে এসে প্রকল্পটি সুন্দরবনের থেকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেত। তা হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তা-ও হতো না। আমরা তাঁর দিল্লি যাওয়ার আগেই জানতে পারতাম ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি/সমঝোতা স্মারক আসলেই আমাদের স্বার্থ কতটা আদায় করবে। একটি সক্রিয়, প্রাণবন্ত সংসদ থাকলে এসব নিয়ে সেখানেই হয়তো আলোচনা হতো। হয়তো তিস্তা চুক্তি নিয়ে আমাদের অপেক্ষা আর আক্ষেপ এত দিনে ঘুচত।
এসব বিষয়ে এখন কথা বলাটাও ভাঙা গ্রামোফোন বাজানোর মতো হয়ে গেছে। মানুষ নতুন কিছু শুনতে চায়। মানুষ নতুনের জন্য কান পেতে থাকে।
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যাঁরা মেয়র হন, সাংসদ হন, উপজেলা চেয়ারম্যান—এসব হন, তাঁরা যে সবাই লন্ড্রি থেকে বের হওয়া তুলসীপাতা, তা নয়, তাঁদের কারও কারও নামে গুরুতর অভিযোগ, এমনকি হত্যা মামলাও থাকে। কিন্তু সরকারি দলের হলে তখন তাঁরা চলে যান আইনের ওপরে, আইনের লম্বা হাতেরও দীর্ঘতর দূরত্বে। কিন্তু বিরোধী দলের হলে তাঁদের জন্য খবর অপেক্ষা করে। বিরোধী দলের হলে আবার তাঁদের ওপর মামলা চাপানোও হয়। সব সরকারই এই পদ্ধতিতে বিরোধী দলকে চাপে রাখার একটি উপায় হিসেবে দেখে।
গত পাঁচ-সাত বছরে পৌর ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরা ভালো জয় পেয়েছেন। রাজশাহী, সিলেট ও গাজীপুরে; সবশেষে কুমিল্লায় তাঁরা জিতেছেন; জিতেছেন হবিগঞ্জেও। কিন্তু মেয়রদের শুরু থেকেই কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাঁরা জেলেও গিয়েছেন। (কুমিল্লার নতুন মেয়র আশা করি শুরু থেকেই কাজ করার সুযোগ পাবেন।)
সিলেট, রাজশাহী আর হবিগঞ্জের মেয়ররা আইনি লড়াই শেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে পদ ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু চেয়ারে বসার পরপরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁদের বরখাস্ত করল, তাঁরা আবার আদালতে গিয়ে চেয়ারে বসার অধিকার পেলেন।
পুরো বিষয়টাতেই গণতন্ত্রের প্রতি একধরনের অশ্রদ্ধার মনোভাব দেখা গেল। ভোটারদের প্রতিও এতে সম্মান দেখানো হলো না। তবে মন্দের ভালো, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেও পিছিয়ে এসেছে। আমরা আশা করি, সরকার এখন এসব মেয়রকে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা এবং সহযোগিতা দেবে, যাতে তাঁরা নিজ নিজ শহরের জন্য কাজ করতে পারেন। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ভালো কাজ করছেন, সবার সমর্থন তিনি পাচ্ছেন। তাতে ঢাকা আরেকটুখানি বাসযোগ্য হচ্ছে। আমার নিজের শহর সিলেটের, মেয়র আরিফুল হক বলেছেন, তিনি সিলেটের উন্নতির জন্য কাজে নামবেন। আমি আশা করব, তিনি আস্তিন গুটিয়ে নেমে পড়বেন এবং সরকার তাঁকে সব রকমের সহযোগিতা দেবে। সিলেট আরও বাসযোগ্য হলে সবাই তার সুফল ভোগ করবে। তখন আওয়ামী লীগের লোকজনও তাঁকে সমর্থন দেবে। গণতন্ত্রে এমনটি হওয়াই তো উচিত।
রাজশাহী এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবুজ শহরের স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজশাহীর মেয়র বুলবুল তাকে আরও সবুজ করলে আনন্দটা হবে সবার। এতে বড় যে লাভ হবে, এসব উন্নয়নের প্রশংসায় সরকারও ভাগ পাবে।
তবে সবচেয়ে বড় লাভ হবে গণতন্ত্রের। বাংলাদেশের মানুষ যত সামনে এগোয়, এর অর্থনীতি যতই সামনের দিকে দৌড়ায়, আমাদের গণতন্ত্র কেবলই উল্টো পায়ে, উল্টো পথে হাঁটে।
নির্বাচনের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই শহরগুলোর মেয়রদের কাজকর্মকে সহজ করার মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন একটা যাত্রা শুরু হোক এবং তখন মেয়ররা যত সফল হবেন, তাঁরাও যেন নিজেদের এবং নিজ দলের পাশাপাশি সরকারের ভূমিকাটাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। দেখা যাক।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।