গত ৭ জুন ঢাকার জুরাইনে মোটরসাইকেল আরোহী এক আইনজীবী দম্পতিকে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে আটকায় পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলেন, কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট নারীর গায়ে হাত তোলেন এবং ওই দম্পতিকে পুলিশ বক্সের দিকে নিয়ে যান। এরপর এলাকার লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁরা পুলিশ বক্স লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং পুলিশ সদস্যদের ওপর চড়াও হন। এতে এক সার্জেন্টসহ পুলিশের তিন সদস্য আহত হন। এ ঘটনার কিছু সময় পর নাগরিক অধিকারকর্মী মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। তিনি বলেন, ‘পুলিশের চাঁদাবাজি নিয়ে স্থানীয় লোকজন বিরক্ত। মূলত তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আজ’ (৮ জুন, প্রথম আলো)। তাঁর এই বক্তব্যের সূত্র ধরে পুলিশ বৃহস্পতিবার মিজানুরকে আটক করে এবং ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ শেষে চার ঘণ্টা পর তাঁকে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু বিষয়টা এখানেই থেমে থাকেনি। জুরাইনের ঘটনায় পুলিশ মামলা করে এবং মোটরসাইকেল আরোহী ওই নারীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। ৮ জুন তাঁদের ঢাকার সিএমএম আদালতে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত ওই নারীকে জামিন দেন এবং বাকি পাঁচজনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। যাঁদের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়, তাঁদের মধ্যে একজন আইনজীবী এবং আরেকজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী। রিমান্ড মঞ্জুরের প্রতিবাদে সিএমএম আদালতের সামনে অবস্থান নিয়ে কয়েকশ আইনজীবী বিক্ষোভ করেন।
আইনজীবীদের বিক্ষোভের মুখে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নেতারা, ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্য বিচারকেরা কয়েক দফায় বৈঠকে বসেন। ডিএমপির অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. জাফর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে রিমান্ডের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পরিপালনের বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয় এবং মৌখিকভাবে দুই আইনজীবীকে রিমান্ডে না নিয়ে জেলহাজতে রাখার সিদ্ধান্ত হয় (৮ জুন, যুগান্তর অনলাইন)।
বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ৯ জুন দুই আইনজীবীর রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। রিট আবেদনের শুনানির পর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ রিমান্ড কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন এবং অধস্তন আদালতে মামলার নথি তলব করেন। আদালত রোববারের মধ্যে ওই নথি পাঠানোর আদেশ দেন এবং একই দিন পরবর্তী শুনানি হবে বলে জানান। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে অবহিত করেন, আইনজীবীদের রিমান্ড সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে এবং গ্রেপ্তারকৃতরা জেলহাজতে আছেন। রোববার চেম্বার আদালত মামলার নথি তলব করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেন। মঙ্গলবার (১৪ জুন) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে শুনানির সময় দুই আইনজীবীকে নিম্ন আদালতে জামিন চাইতে বলা হয়। ওই দিন সিএমএম কোর্টে জামিনের আবেদন করলে এক আইনজীবীর জামিন মঞ্জুর করা হয়।
ওপরে বর্ণিত এই ঘটনাগুলো থেকে পুলিশ, বিচারক ও আইনজীবীদের ভূমিকা এবং একই সঙ্গে বিচার বিভাগ, বিশেষভাবে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গণমাধ্যমে দেওয়া একজন নাগরিকের বক্তব্য নিয়ে পুলিশের এমন ‘কড়া’ প্রতিক্রিয়া দেখানোর উদ্দেশ্যটা কী? তাঁকে আটক করা নিয়ে কেন এ রকম লুকোচুরি খেলতে হলো? কাউকে আটক করা হলে তাঁর নিকটাত্মীয় বা বন্ধুকে আটকের স্থান ও সময় এবং কোথায় বা কার হেফাজতে আটক রাখা হয়েছে, তা জানাতে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। আরও অনেকের মতো মিজানুরকে আটকের ক্ষেত্রেও এই নির্দেশনা মানা হয়নি। এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁকে শারিরীক ও মানসিকভাবে নিগ্রহের গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে।
ট্রাফিক পুলিশের ওপর স্থানীয় লোকজনের চড়াও হওয়ার ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের মতামত প্রকাশ করেছিলেন জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান। তিনি সেই ঘটনাকে স্থানীয় মানুষজনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বর্ণনা করেন। এ ছাড়া পুলিশের দায়ের করা মামলা সম্পর্কেও তিনি ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস দেন। একটিতে লেখেন, ‘দুটি ঘটনা ঘটবে বলা যায়। এক. মামলা-বাণিজ্য। দুই. মামলার ভয় দেখিয়ে ঘুষ-বাণিজ্য। এমন একটি রাষ্ট্রে বাস করছি যেখানে এ ঘটনার নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু তদন্ত চাইব, সে অবস্থাও নেই’ (৯ জুন, প্রথম আলো অনলাইন)।
বুধবার সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য এবং ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে মিজানুরকে পুলিশ আটক করে। শ্যামপুর থানা-পুলিশ ও ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ) প্রথমে তাঁকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। এ রকম অবস্থায় দেশে-বিদেশে থাকা মিজানুরের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে আটক করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হন, কেউ কেউ মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সেখান থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মিজানুর বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গণমাধ্যমে দেওয়া আমার বক্তব্য উসকানিমূলক বলে মনে করছেন ডিবির কর্মকর্তারা। আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।’ পুলিশী হেফাজতে শারিরীকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন এবং তাঁকে হুমকি-ধামকিও দেওয়া হয়েছে বলে তিনি ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন।
গণমাধ্যমে দেওয়া একজন নাগরিকের বক্তব্য নিয়ে পুলিশের এমন ‘কড়া’ প্রতিক্রিয়া দেখানোর উদ্দেশ্যটা কী? তাঁকে আটক করা নিয়ে কেন এ রকম লুকোচুরি খেলতে হলো? কাউকে আটক করা হলে তাঁর নিকটাত্মীয় বা বন্ধুকে আটকের স্থান ও সময় এবং কোথায় বা কার হেফাজতে আটক রাখা হয়েছে, তা জানাতে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। আরও অনেকের মতো মিজানুরকে আটকের ক্ষেত্রেও এই নির্দেশনা মানা হয়নি। এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁকে শারিরীক ও মানসিকভাবে নিগ্রহের গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া এবং ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করাই কি এর উদ্দেশ্য? পুলিশের এ ধরনের ভূমিকা নাগরিক অধিকার এবং একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল।
জুরাইনের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পাঁচজনের রিমান্ড মঞ্জুর করা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। যাঁদের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়, তাঁদের মধ্যে দুজন আইনজীবী; এর ফলে আদালত প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের যে বক্তব্য জানা যায় তা হলো, এই মামলায় আসামিদের রিমান্ডে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই মামলার বাদী পুলিশ এবং যে ঘটনার সূত্র ধরে মামলাটি উদ্ভূত, সেই ঘটনায় পুলিশ একই সঙ্গে জড়িত এবং আক্রান্তও বটে। সুতরাং এ ধরনের একটি মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের সেই পুলিশের কাছেই রিমান্ডে পাঠানোটা খুবই আশঙ্কাজনক ও অবিবেচকের একটি কাজ এবং একই সঙ্গে রিমান্ড নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনারও লঙ্ঘন।
আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করার পর ঘটনার ‘নাটকীয়তা’ আরও বেড়ে যায়। আইনজীবীদের বিক্ষোভের মুখে আইনজীবী সমিতির নেতারা, ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্য বিচারকেরা কয়েক দফায় বৈঠকে করেন এবং ‘মৌখিকভাবে’ রিমান্ডের আদেশ স্থগিত করার কথা জানানো হয়। আদালত বা আইনজীবীরা নয়, খুবই আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথমে সংবাদমাধ্যমের কাছে রিমান্ডের আদেশ স্থগিত হওয়ার বিষয়টি জানান। তবে নিম্ন আদালত কর্তৃক রিমান্ড স্থগিত করার লিখিত বা আনুষ্ঠানিক কোনো আদেশ কেউ দেখাতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো ওঠা খুব স্বাভাবিক যে পুলিশ চাওয়া মাত্রই আদালত কোন বিবেচনায় প্রথমে রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, আর কেনই বা আইনজীবীদের চাপের মুখে রিমান্ড স্থগিত করলেন? রিমান্ড স্থগিতের লিখিত বা আনুষ্ঠানিক কোনো আদেশ ছাড়াই কীভাবে তা কার্যকর হলো? ‘মৌখিকভাবে’ রিমান্ড স্থগিতের বিষয়টি আদালত বা আইনজীবীরা জানানোর আগেই পুলিশ কীভাবে জানল? এসব ঘটনাক্রম এবং পরিস্থিতিতে এমনটা মনে হতেই পারে, আইন বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নয়, বিভিন্ন মহলের চাপে ও প্রভাবেই নিম্ন আদালত একেকবার একেক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঢাকার সিএমএম আদালতে দুই আইনজীবীর রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর তাঁদের সহকর্মীরা আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ দেখান এবং কার্যত এই বিক্ষোভের ফলে আদালত ‘মৌখিকভাবে’ রিমান্ড আদেশ স্থগিত করেন। বিষয়টি নিয়ে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগেও দ্রুত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর যে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন, তিনিই আবার এক আইনজীবীর জামিন মঞ্জুর করেন। এভাবে রিমান্ড মঞ্জুর, ‘মৌখিকভাবে’ রিমান্ড স্থগিত, উচ্চ আদালতে শুনানি এবং আইনজীবীর জামিন লাভ—মামলার আসামি আইনজীবী না হয়ে সাধারণ কোনো মানুষ হলে এই ঘটনাগুলো এভাবে এত দ্রুত ঘটা সম্ভব ছিল?
জুরাইনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আইনজীবী ও নিম্ন আদালতের ভূমিকায় মানুষের মধ্যে এই ধারণা আরও জোরদার হলো যে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিই এই দেশে আসল কথা।
মনজুরুল ইসলাম সাংবাদিক