বুকের ওপর ভারী পাথর চেপে আছে। শব্দ খুঁজে পাই না। চিন্তা গুছিয়ে আসে না। নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। মেকি মনে হয়। দায়ী মনে হয়।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির রেস্তোরাঁয় গত শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত চলা জিম্মি সংকট ও হত্যাযজ্ঞ কোনো ভয়ের কল্পনা না। এটা সিনেমা না, খেলা না, বিনা মেঘে বজ্রপাত না। এটা শুরুও না, শেষও না।
প্রায় দুই বছর ধরে, তারও অনেক কটা বছর আগে থেকে, দেশে জঙ্গি হামলায় হত্যার ঘটনা ঘটছে। আর্টিজান বেকারির হত্যাযজ্ঞ যেন সেই সব ঘটনার চাপ ধারণ করে এক ধাক্কায় মনকে একটা অতল খাদে ফেলে দিয়েছে।
ঘটনাগুলো দেশি ষড়যন্ত্র, দেশি জঙ্গিবাদ নাকি আইএস অথবা আল-কায়েদার জঙ্গিবাদের ফসল—তা নিয়ে এখন বিতর্ক করা বেকার। সত্য হচ্ছে, ধর্মীয় আর সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার বৈশ্বিক রাজনীতি আমাদের ঘরও তছনছ করে দিচ্ছে।
আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজ পাঁচজন হামলাকারীর যে ছবি ছাপিয়েছে, সেটা দেখতে গেলে তাদের লেবাস আর হাতের অস্ত্র ছাপিয়ে চোখে পড়ে হাসিমাখা মুখগুলো। মুখ থেকে কৈশোরের ছাপ মোছেনি। হাসি অমলিন। জিম্মি উদ্ধার অভিযানের সময় তারা নিহত হয়। ছবিগুলো দেখে কিছুতেই তাদের দানব ভাবতে পারছি না।
কিন্তু এটা তো ঠিক যে আদর্শের নামে, ধর্মের নামে এরা ২০ জন মানুষকে নির্যাতন করে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। ময়নাতদন্তকারী একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেছেন, নিহত দেশি-বিদেশি ১০ নারীকে বেশি নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের ছেলেদের বয়সী এই ছেলেরা এতটা সময় ধরে, এত রক্তপাত ঘটিয়ে, এত নির্যাতন চালিয়ে এতগুলো নরহত্যা করতে পারল?
এরা কেন এমন হলো? ঘৃণা, হিংসা, প্রতিহিংসা? কার প্রতি? কেন? কীভাবে, কত দিনে প্রশিক্ষিত হলো? কারা কীভাবে এদের মধ্যে এই উন্মাদনার বীজ বুনল আর লালন করল? কীভাবে তাদের এমন অধর্ম, অন্ধবিশ্বাস আর আদর্শ গেলানো সম্ভব হলো? এরা নির্বিকার নিষ্ঠুরতায় যাঁদের হত্যা করেছে, তাঁদের প্রিয়জনদের কথা ভাবলে মন স্থবির হয়ে যায়। আর এদের বাবা-মায়ের কথা ভাবলে বুকটা হিম হয়ে আসে।
>তারুণ্য আদর্শ খোঁজে, বিশ্বাস আঁকড়ে ধরতে চায়, রোমাঞ্চ খোঁজে। রাগে-ক্ষোভে-বঞ্চনায় সহিংসও হয়তো হতে পারে। ইসলামের নামে কিশোর-তরুণদের ভুল বুঝিয়ে প্রভাবিত করা হয়, এমন মোটা দাগের ব্যাখ্যা দেওয়া যেতেই পারে
ঠিক যেমন আমি বা আমার প্রিয়জন কেউ যেকোনো দিন এমন কারও হাতে নিহত হতে পারি, তেমনি যেকোনো সময় আমারই ঘরের কোনো ছেলেমেয়ে এমন হয়ে উঠতে পারে। কোন ভয়টা আমার বেশি হচ্ছে, আমি সত্যিই তা জানি না।
নিহত জঙ্গিদের যে চারজনের পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে, তাদের একজন দরিদ্র পরিবারের মাদ্রাসায় পড়া ছেলে। বাকিরা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে, ঢাকার নামকরা বড় স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। ইংরেজি শিক্ষা আর কেতায় চৌকস। অর্থাৎ জঙ্গি বলতে যে ছকবাঁধা ছবি আমাদের চোখে ভাসে, এ তিনজন তা নয়। এদের দুজন অনেক দিন হলো নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। একজন যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলে বাড়িতে চিঠি লিখে গিয়েছিল বলে শুনতে পেয়েছি।
তারুণ্য আদর্শ খোঁজে, বিশ্বাস আঁকড়ে ধরতে চায়, রোমাঞ্চ খোঁজে। রাগে-ক্ষোভে-বঞ্চনায় সহিংসও হয়তো হতে পারে। ইসলামের নামে কিশোর-তরুণদের ভুল বুঝিয়ে প্রভাবিত করা হয়, এমন মোটা দাগের ব্যাখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি, এদের মন তলিয়ে বুঝতে এবং এদের সঙ্গে কথা বলতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণমাধ্যমে, সামাজিক পরিসরে, পরিবারের মধ্যে। ঘরে ঘরে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মসংস্কার আর মতবিশ্বাসের নানান সংকীর্ণ খাপের মধ্যে আমরা বাস করি। ‘আমরা’ আর ‘অন্যরা’—এই ভাগগুলো অনেক বেশি। আছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আছে মত, বিশ্বাস আর চিন্তার উগ্র দখলদারি। ধর্মের উদার মানবতাবাদী ব্যাখ্যার জন্য জায়গা কি আমরা তৈরি করতে পারব? আমরা কি একেবারে ভিন্নমতের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, তার কথা শুনতে বা বুঝতে এখনো চেষ্টা করব না?
পুলিশ বলছে, একজন জঙ্গিকে জীবিত আটক করা হয়েছে। কিন্তু তার সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পুলিশ জানায়নি। যদি সত্যিই কেউ ধরা পড়ে থাকে আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, সে কি ফারাজ আইয়াজ হোসেনের অতুলনীয় সাহস আর সমমর্মিতা-মানবতা লক্ষ করেছিল? সে আর তার সঙ্গীরা কি ফারাজকে নিয়ে কোনো কথা বলেছিল? তাদের উন্মাদনার শিকার ওই মানুষদের কথা এখন কি তার মনে পড়ে? মানুষের মধ্যেই মানবতা বাস করে। মানবতা আর সমমর্মিতা ছাড়া ভরসা করার জায়গা কোথায়?
হলি আর্টিজান বেকারির ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা দিতে আমাদের রাষ্ট্রের প্রস্তুতি কত আনাড়ি, ক্ষমতা কত অপ্রতুল। তা ছাড়া, যে বিপদের মধ্যে আমরা আছি বিশ্বের খুব দক্ষ রাষ্ট্রশক্তিও তার মোকাবিলা করতে পারছে না। মন থেকে মনে যে শত্রুর বিস্তার ও বিকাশ, বাইরের যুদ্ধ তাকে শেষ করবে কী করে?
কুররাতুল-আইন-তাহমিনা: সাংবাদিক।