ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ। দিনের শুরুটা অন্য সকালগুলো থেকে অনেকটা আলাদা ছিল। বায়ুদূষণের শীর্ষে থাকা রাজধানী ঢাকা থেকে দূরের একটি শহরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেলাম। শীতের ঈষৎ মধুছন্দ তখনো মিলিয়ে যায়নি। সিলেট বিমানবন্দর থেকে শহরের দিকে যেতে ভালো লাগার মতো অনেক দৃশ্য যেমন ছিল, আবার মন্দও কিছু ছিল। শহরতলির কিছু ন্যাড়া ও হতশ্রী অনুচ্চ টিলা এই অস্বস্তিকে আরও উসকে দিল। অথচ প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই শহর একটি মনোজ্ঞ সবুজ নগরের অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারত। তা তো হলোই না, বরং এই প্রকৃতিরানির যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা বিনষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে একটি চিহ্নিত মহল। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেটে এই মুহূর্তে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ মৌলভীবাজার জেলার লাঠিটিলা বন।
সম্প্রতি বন বিভাগ সেখানে একটি সাফারি পার্ক নির্মাণের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করেছে। তাতে বনটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশবাদীরা এই আত্মঘাতী কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে সেদিন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আহ্বানে সিলেটের স্থানীয় একটি হোটেলে সমবেত হলেন পরিবেশকর্মী, সংগঠক, সাংবাদিক এবং বিদ্বৎসমাজের প্রতিনিধিরা। বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের আমন্ত্রণেই মূলত এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমার অংশগ্রহণ।
বাপার সভাপতি মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতেই লাঠিটিলার প্রাণ ও প্রকৃতির বর্তমান চিত্র তুলে ধরেন বাপা সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক বনের সার্বিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য পরিস্থিতির বিশদ ধারাবাহিক তথ্য উপস্থাপন করেন বন্য প্রাণী গবেষক ফরহাদ আহসান। তাঁর তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। পাশাপাশি এটাও বোঝা গেল, সেখানে কীভাবে বিভিন্ন প্রাণের বিলয় ও বিলুপ্তি ঘটেছে। অনুষ্ঠানে সিলেটের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। তাঁরা এসেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, লাঠিটিলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আবাসকে রক্ষার তাগিদে। ভালো লাগার বিষয় যে আত্মমগ্ন না থেকে তাঁরাও পরিবেশ নিয়ে ভাবছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলামের সারগর্ভ আলোচনা এই সভায় ভিন্নমাত্রা যোগ করে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল তাঁর বক্তব্যে লাঠিটিলায় কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রশ্ন তোলেন, বন বিভাগ কীভাবে প্রচলিত বন আইন লঙ্ঘন করে এমন পরিবেশ বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? উপস্থিত সবারই বক্তব্য ছিল অভিন্ন। পরিবেশবাদীরা এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সরকারের ‘প্রকল্পবাজি’ বন্ধ করার আহ্বান জানান। তাঁরা মনে করেন, সংরক্ষণের নামে বনের ভেতর যেকোনো কর্মকাণ্ডই এর ধ্বংস ত্বরান্বিত করবে।
বন বিভাগ যত সাফাইমূলক কথাই বলুক, একটি সমৃদ্ধ বনে সাফারি পার্ক তৈরি হবে আর সেখানকার বাস্তুতন্ত্র অটুট থাকবে, এমন কথাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ আরেকটি হাস্যকর খোঁড়া যুক্তি দিয়েছে—সাফারি পার্ক বানানো হলে বনের বেদখল জায়গা আয়ত্তে আসবে, নতুন করেও আর বেদখল হবে না! অকাট্য যুক্তি বটে! তাহলে তো বন রক্ষার জন্য সারা দেশেই আমাদের আরও অনেক সাফারি পার্ক বানানো দরকার! বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা এখন দেখছি, বন বিভাগ আদতে কোনো বনই রক্ষা করতে পারেনি; সব বনই নিঃশেষের পথে।
এই সহজ-সরল সমীকরণ বোঝার জন্য কি পরিবেশবাদী হতে হয়? একজন সাধারণ মানুষও তা বোঝেন। বোঝেন না শুধু তাঁরা, যাঁরা জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। যেখানে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে বনভূমি বাড়ানোর কথা বলছি, এমনকি বৈশ্বিক পরিসরেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেখানে সাধারণ মানুষকে কিছু বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্যের মিশেলে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি কুচক্রী মহল। শুরুর দিকে লাঠিটিলায় ৫ হাজার ৬৩১ একর জুড়ে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও পরবর্তী সময়ে পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে পরিসর ছোট করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের ওই বনভূমি সেখানকার একমাত্র সংরক্ষিত বন হিসেবে চিহ্নিত। এই বনে অসংখ্য প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস। সম্প্রতি জুড়ী উপজেলার তৈয়বুন্নেছা খানম সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের তত্ত্বাবধানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ আহমেদের সহযোগিতায় সেখানকার উদ্ভিদবৈচিত্র্যের ওপর পরিচালিত জরিপে প্রায় ৭৬ প্রজাতির উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কিছু উদ্ভিদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরো কর্মযজ্ঞ সমন্বয় করেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হাসানুজ্জামান শোয়েব।
প্রত্যন্ত জনপদে এমন একটি গবেষণাকর্ম সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা জানি, মৌলভীবাজার জেলায় আগে থেকেই বর্শিঝোড়া ইকোপার্ক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, মাধবকুণ্ড লেক, বাইক্কার বিলসহ বেশ কিছু পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বছরে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক সেখানে যান। পর্যটকদের জন্য হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রাস্তাসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এর কারণেই ওই বনভূমি ও জলাভূমিগুলোর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে আছে বলে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। তার ওপর আবার কেন সাফারি পার্কের নামে এই পর্যটনকেন্দ্র? ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশে কয়টি সাফারি পার্ক প্রয়োজন?
এটা আসলে একধরনের দুর্বুদ্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। স্থানীয় মানুষকে বোঝানো হয়েছে ‘উন্নয়নের’ কথা। যেহেতু পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি অতি সূক্ষ্ম এবং তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নয়, সেহেতু প্রকল্পবাজদের চটকদারি কথায় স্থানীয় অনেকেই আকৃষ্ট হয়েছেন। জানা যায়, এর পেছনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে একসময়ের একজন পলাতক ‘বনখেকো’। নিশ্চিত করে বলা যায়, অর্থলিপ্সু জঘন্য প্রকৃতির কতিপয় লোক সংশ্লিষ্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্ভট তথ্য দিয়ে সবাইকে বোঝাতে ও পক্ষ আনতে সমর্থ হয়েছে।
বন বিভাগ যত সাফাইমূলক কথাই বলুক, একটি সমৃদ্ধ বনে সাফারি পার্ক তৈরি হবে আর সেখানকার বাস্তুতন্ত্র অটুট থাকবে, এমন কথাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ আরেকটি হাস্যকর খোঁড়া যুক্তি দিয়েছে—সাফারি পার্ক বানানো হলে বনের বেদখল জায়গা আয়ত্তে আসবে, নতুন করেও আর বেদখল হবে না! অকাট্য যুক্তি বটে! তাহলে তো বন রক্ষার জন্য সারা দেশেই আমাদের আরও অনেক সাফারি পার্ক বানানো দরকার! বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা এখন দেখছি, বন বিভাগ আদতে কোনো বনই রক্ষা করতে পারেনি; সব বনই নিঃশেষের পথে। যেহেতু বন রক্ষার কোনো জবাবদিহি নেই, আবার বন ধ্বংস হলে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলারও কেউ নেই, সেহেতু বন নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। কিন্তু একটি সরকারি দপ্তর তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। তাদের কিছু না কিছু তো করতে হয়। শুরু হলো বনকে পর্যটনকেন্দ্র বানানোর প্রক্রিয়া। পর্যটকদের উৎসাহিত করার জন্য সব বনে বানানো হলো পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। তারপর ধীরে ধীরে হোটেল, মোটেল, কটেজ। গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিদেশি গাছ লাগানোর অ্যাজেন্ডাও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলো। সর্বশেষে অভিনব সংযোজন সাফারি পার্ক বানানোর নামে এই প্রহসন। এগুলো মূলত একধরনের চিড়িয়াখানার বর্ধিত সংস্করণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আমাদের প্রাণের দাবি, লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক বানানোর নামে বন ধ্বংসের এই উৎসব থেকে বন বিভাগকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। যদি সেখানে সত্যিকার উন্নয়নই করতে হয়, তাহলে জেলা সদরের কাছে বর্শিছড়ায় যে ইকোপার্ক প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে, তার উন্নয়ন করা হোক। এমনকি চাইলে বৃহত্তর সিলেটের সুবিধাজনক কোনো স্থানে একটি আঞ্চলিক বোটানিক্যাল গার্ডেনও করা যেতে পারে। তাতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
মোকারম হোসেন প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক, ‘তরুপল্লব’। tarupallab@gmail.com