মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার একটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার একটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী

মতামত

ছুরি–কাঁচি ও ক্রসফায়ারের ইউপি নির্বাচন

প্রথম আলোসহ বেশ কটি পত্রিকায় সচিত্র খবরটি ছাপা হয়েছে। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ছুরিকাঘাতে জখম হয়েছেন। রোববার গোলাম রাব্বানী গাংকান্দি সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলে বেলা তিনটার দিকে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন। এ সময় তাঁর ডান হাতের দুটি আঙুল ছুরির আঘাতে জখম হয়। গোলাম রাব্বানীর মামা সালাহ উদ্দিন মিয়া নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী (গিটার প্রতীকে) ছিলেন। আহত গোলাম রাব্বানী জানান, ‘জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে, এমন খবর পেয়ে আমি কেন্দ্রের ভেতরে যাই। আমি তাদের জাল ভোট দেওয়া বন্ধের অনুরোধ জানাই। তখন মোশাররফ মোল্লার ছেলে সোহেল মোল্লা আমাকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে।’

এখানেই শেষ নয়। নির্বাচনের পরদিন একই উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে বিজয়ী ও পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪০ জন আহত হয়েছেন। ১০টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে দুটিতে। লুটপাটের সময় ঘরে আটকে পড়া এক বৃদ্ধ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। নির্বাচন কমিশন চতুর্থ ধাপে যে ৮৩৬টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করেছে, মাদারীপুরের ঘটনা তার খণ্ডিত চিত্র মাত্র।

এই ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দলের প্রার্থী ছিলেন না। আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এতই উদার যে কারও হাতে নৌকা না দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত রেখেছে। নির্বাচনের ফলাফলের পর সেই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত সংঘর্ষে রূপ নিল।

একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ন্যূনতম যে পরিবেশ থাকার কথা, নির্বাচন কমিশন তা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইউপি নির্বাচন বর্জন করায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। মাদারীপুরের ইশিবপুরের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত ছুরিকাঘাতে রূপ নিয়েছে এবং ছাত্রলীগের এককালীন ডাকসাইটে নেতা ও ডাকসুর সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানী ছুরিকাহত হয়েছেন। এ ঘটনা বিএনপি বা অন্য কোনো দলের নেতা-কর্মী ঘটালে আওয়ামী লীগের নেতারা সমস্বরে স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশবিরোধী ও উন্নয়নবিরোধী যড়যন্ত্র বলে প্রচার করতেন। এখানে আক্রান্ত ও আক্রমণকারী দুই পক্ষ ক্ষমতাসীন দলের।

গণতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না, মাটিতেও গজায় না। গণতন্ত্র হলো অনুশীলনের বিষয়। চর্চার বিষয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গায়ের জোরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নিজের জয় নিশ্চিত করতে তাঁরা প্রতিপক্ষের ভোটাধিকার হরণ করতে, বাড়িঘরে হামলা করতে, আগুন দিতেও দ্বিধা করেন না। আগে নির্বাচনী সংঘাত হতো ভোটকেন্দ্রে। এখন তফসিল ঘোষণার পর থেকেই জবরদস্তি শুরু হয়। ফলাফল ঘোষণার পর এর জের চলতে থাকে কয়েক দিন ধরে। কখনো বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকেরা পরাজিত প্রার্থীর বাড়িঘরে হামলা চালান, কখনো পরাজিত প্রার্থীর অনুসারীরা বিজয়ী প্রার্থীর অফিস-কাচারি ভাঙচুর করেন। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি যে জনগণ বা ভোটার, তাঁদেরই ভূমিকা নেই।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রোববার অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী ও সিলেটে নিহত হন তিনজন। কিছু স্থানে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, সংঘর্ষ, গুলি এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ভোটের দিন সহিংসতায় যথাক্রমে ৬ ও ৭ জন নিহত হয়েছিলেন। রোববারের নির্বাচনী সংঘাতে আহত হন ৫২ জন। এ পর্যন্ত দেশজুড়ে নির্বাচনী সংঘাতে ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

গণতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না, মাটিতেও গজায় না। গণতন্ত্র হলো অনুশীলনের বিষয়। চর্চার বিষয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গায়ের জোরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নিজের জয় নিশ্চিত করতে তাঁরা প্রতিপক্ষের ভোটাধিকার হরণ করতে, বাড়িঘরে হামলা করতে, আগুন দিতেও দ্বিধা করেন না।

অথচ কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন সব নির্বাচনকেই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলে অভিহিত করে। নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছেন, চতুর্থ ধাপে ৮৩৬টি ইউপিতে আনন্দমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। ভোট পড়ার হার ৭০ শতাংশের বেশি হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। উৎসবমুখর পরিবেশে যে নির্বাচন হলো, সেখানে আত্মরক্ষার্থে পুলিশকে কেন গুলি চালাতে হলো?

মাঠপর্যায়ে এ সংঘাত ও সংঘর্ষের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-সাংসদদের হুমকি-হুংকার-হুঁশিয়ারিও টনিক হিসেবে কাজ করেছে। নেতারা যা হুকুম দিয়েছেন, কর্মীরা তা প্রতিপালন করেছেন মাত্র। পাবনার বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে ছেলেকে বিজয়ী করতে পাবনা-১ আসনের সাংসদ শামসুল হক প্রতিপক্ষের লোকজনের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কোনো দয়ামায়া না করে পিষে মেরে ফেলা হোক।’ তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তারপরও জনগণের রায়ের ওপর ভরসা না করে ভরসা করেছেন পিষে ফেলার ওপর। সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ হাসিনা দৌলা নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বিদ্রোহী প্রার্থীদের হাত-পা ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।

মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক ইউপি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে একবারের জায়গায় তিনবার ব্যালটে সিল মারার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজশাহী জেলার বাগমারার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট না দিলে হিন্দুধর্মের লোকজনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণা দেন সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম সারওয়ার। লক্ষ্মীপুরের আরেক নেতা নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিলে ‘ধরে এনে ক্রসফায়ার’ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আরেক আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, ‘নৌকার ভোট কাইত্যার (বুথ বোঝাতে) তলে হবে না। হবে টেবিলের ওপর এবং ওপেন। যাঁরা কথা শুনবেন না, তাঁদের জন্য আছে হয়রানি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু হুমাইপুরের জনগণের শক্তি নিয়ে ওই দিন আসব না। শুধু একে-৪৭ নয়, প্রয়োজনে যা করা দরকার সবই করব।’ কর্মী-সমর্থকদের অভয় দিয়ে ওই নেতা বলেন, ‘প্রশাসন আমাদের। পুলিশ আমাদের। সরকার আমাদের।

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউপি নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে ভোট দিলে কারও বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আফজাল হোসেন মোল্লা। লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সূর্যমণি বাজারে নির্বাচনী পথসভায় তিনি বলেন, ‘আবদুস সোবহান গোলাপ (মাদারীপুর-৩ আসনের সাংসদ) এত নরম না। সে রোববার থেকে স্টিম রোলার চালাতে বলবে, আপনারা (নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা) চালাবেন। আর আমি থাকব আমার কাছে দুইডা অস্ত্র লইয়া। দুইডা অস্ত্র লইয়া আমি থাকমু, কারও বাপ-পুত থাকলে আমার সামনে জানি আসে। দয়া কইরা নৌকার বিরুদ্ধে কেউ যাইয়েন না। নৌকার বিরুদ্ধে গেলে কারও বাঁচন নাই।’

সে ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের চার দফা নির্বাচনে যে মারামারি–কাটাকাটি হয়েছে, তার দায় আওয়ামী লীগের এই হুমকিদাতারাও এড়াতে পারেন না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁদের কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায় না। এর অর্থ তাঁদেরও মৌন সম্মতি আছে।

আর নির্বাচন কমিশনের কথা যত কম বলা যায়, তত ভালো। কেননা কে এম নূরুল হুদা কমিশন নিজেই পদে পদে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। তারা অন্যকে আইন মানাবে কী করে?

রোববার দ্য ডেইলি স্টার-এর খবরে দেখলাম, কমিশন নিজেই আইন ভেঙে একজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা নিয়েছে নির্ধারিত সময়ের পর। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল ৯ ডিসেম্বর। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চাঁদনিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ইফতেখারুজ্জামান ৮ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। পরদিন এমদাদুল হক আওয়ামী লীগের সুপারিশসহ মনোনয়নপত্রসহ প্রার্থিতা জমা দেন। ১০ তারিখে ইফতেখারুজ্জামান ফের আওয়ামী লীগের সুপারিশসহ প্রার্থিতা জমা দেন। স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে স্থানীয় সাংসদের চাপে তাঁরা ১২ ডিসেম্বর ইফতেখারুজ্জামানের মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনে পাঠালে তাঁরা গ্রহণ করেন।

যে নির্বাচন কমিশন প্রভাবশালীদের চাপে নির্ধারিত সময়ের পরও মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে পারে, সেই নির্বাচন কমিশনের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। নির্বাচনের নামে কেবল তারা জনগণের ভোটাধিকারই হরণ করেনি, অনেক সংঘাত-প্রাণহানিও ঘটিয়ে চলেছে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com