ছিটমহল বিনিময়ের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত

ছিটমহলজীবনের অবসানে আনন্দ–উল্লাস
ছিটমহলজীবনের অবসানে আনন্দ–উল্লাস

অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ‘অপদখলীয় জমি’ ও ‘ছিটমহল’ থাকা অযৌক্তিক ব্যাপার, যদি সেটা উদ্ভট না-ও হয়। এমন মনোভাবের জন্য তাদের ক্ষমা করা যেতেই পারে, সঠিকভাবেই। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই ছিটমহলের অস্তিত্ব ভূমিসংক্রান্ত আরও অনেক অযৌক্তিক বন্দোবস্তের মধ্যে একটি, এটা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারও বটে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোরই দুর্ভাগা মানুষের ওপর খুবই মর্মপীড়াদায়ক প্রভাব রয়েছে।
এটা সত্য যে প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগের অনেক কিংবদন্তিই এখানে রয়েছেন, যখন এসব অঞ্চলের জমিদারেরা দাবা খেলার মধ্য দিয়ে জমি ও তাতে বসবাসকারী মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতেন। এভাবে নির্দোষ মানুষ শেষ বিচারে দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে প্রায় দুই শতাব্দী সময় হাতে পেয়েছিলেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভারত ত্যাগের আগে তাঁরা খুব সামান্যই মূল্যবান কাজ করেছেন। তাঁদের কাছে শেষমেশ এটা ছিল ‘ভাগ করে দিয়ে চলে যাও’ নীতি।
ফলে স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের ঘাড়ে এই ঐতিহাসিক ভুল শোধরানোর দায়িত্ব পড়ে, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজার ভার পড়ে। এ লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তি, লোকের কাছে তা এ নামেই জনপ্রিয় ছিল। যদিও সদ্য স্বাধীন দেশ দুটির মধ্যকার অনাস্থা ও তাদের সম্পর্কের রসায়ন বা তার অভাবের—যেটি এই সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য—কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তৈরি করে। দৃশ্যত এই উদ্যোগটি সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের এক মহান উদ্দেশ্য হিসেবেই মনে হয়েছিল। তারপর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তাতে ভারতের ভূমিকার কারণে পুরো ব্যাপারটাতেই নাটকীয় পরিবর্তন আসে। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে যে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তা ছিল নতুন সমীকরণের সুস্পষ্ট ফলাফল। চুক্তির পর বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে নিজের কথা রাখে। অর্থাৎ চুক্তিটি বাংলাদেশের সংসদে অনুসমর্থন করা হয়, আর দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে চুক্তিটির বাস্তবায়ন আটকে যায়; কখনো আইনি, কখনো ব্যবহারিক, আবার কখনো রাজনৈতিক কারণে তা আটকে গেছে।
২০০১ সালের শেষের দিকে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি এ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হই। আমার আমলে এ বিষয়টিকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা আন্তরিকতার সঙ্গেই এ কাজটি শুরু করেছিলাম। এ কাজে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকর্মী, যেমন তৎকালীন মহাপরিচালক মাহমুদ হাসান, তাঁর উত্তরসূরি হুমায়ুন কবির, তৎকালীন পরিচালক শেখ মোহাম্মদ বেলাল ও সহকারী সচিব ফয়েজ মুরশিদ কাজী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আর বিষয়টিকে রাজনৈতিক পূর্ণাঙ্গতা দিয়েছেন তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান, তিনি ছিলেন আমাদের শক্তির এক মহান উৎস।
মৃদুস্বরে বললে বলতে হয়, কাজটি খুব কষ্টকর ছিল, কাজ করতে হতো দীর্ঘ সময় ধরে। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ভারত-বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে গিয়ে যেসব অদ্ভুত কাজ করেছিলেন, তার কারণে এই কাজটা দ্বিগুণ কঠিন হয়ে যায়। মাতামুহুরী নদী ঘেঁষে সীমানা চিহ্নিতকরণের ব্যাপারটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। গতিপথ পরিবর্তনের জন্য মাতামুহুরী কুখ্যাত, প্রতিটি বাঁকেই যেন নদীটি দিক বদলেছে। রেকর্ডে দেখা যায়, ১৯৭৪ সাল থেকে মুহুরী নদীর গতিপথে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এটাও নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়। লাঠিটিলায় সীমানা নির্ধারণ তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল, আর দইখাতায় তা আপেক্ষিকভাবে সহজ ছিল। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে ছিল ছিটমহলের আদমশুমারি, আর ভূমি বিনিময়ের কারণে যারা আক্রান্ত হতে পারে, তাদের সংখ্যা নির্ধারণ।
২০০৪ সালের শেষে আমরা একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে প্রস্তুত ছিলাম। এটা ছিল একটা প্যাকেজের মতো। এর মধ্যে ছিল সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিত করা, আর তার সঙ্গে ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময়। এটা ১৯৭৪ সালের চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। মন্ত্রিসভায় যে রাজনৈতিক গুরুরা ছিলেন, তাঁদের নীতিগত অনুমোদনও যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। গোলযোগ সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক শক্তির মদদে প্রশাসনের একটি অংশ এই প্রকল্পটি বানচাল করার চেষ্টা করে। ব্যাপারটা হতাশাজনক ছিল। আমার কিছু ক্ষমতা ব্যবহারের এখতিয়ার ছিল, সেই বলে বলীয়ান হয়ে ২০০৪ সালের দ্বিতীয় ভাগে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের কাছে প্রস্তাব পেশ করি। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা আমাদের প্রস্তাব ঘাঁটাঘাঁটি করে উত্তর দেন, ‘এটা এমন এক প্রস্তাব, যা নাকচ করা কঠিন।’ রাজনৈতিক বিবেচনা যেন পথের কাঁটা না হয়, সে বিষয়টিতেও জোর দেওয়া হয়। আবার সমালোচকদের এটা বোঝানোও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলে তা কোনো পক্ষের জন্যই জমি প্রাপ্তি বা হারানোর কারণ হবে না। আসলে ১৯৪৭ সাল থেকে যা চলে আসছে, এই চুক্তির মাধ্যমে সেটাকে আইনি বৈধতা দেওয়া হবে, যেটা এত দিন কার্যত কার্যকর ছিল।
২০০৫ সালের মার্চে আমি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাই, ফলে তখন থেকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি আর সরাসরি জড়িত ছিলাম না। উভয় তরফ থেকেই এ বিষয়ে আর কোনো নড়াচড়া দেখলাম না, এতে নিরাশই হলাম। বিদ্যমান নথিপত্র থেকে দেখলাম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ২০০৬ সালের নয়াদিল্লি সফরের সময় কোনো পক্ষই এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাতও করেনি। এটা নিদারুণ যন্ত্রণারই বিষয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের সেই বৈধতা ও সক্ষমতা ছিল না যে তারা এ–বিষয়ক আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ব্যাপারটা মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল, আর ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়টিকে প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলা যায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসারে কয়েক হাজার স্ট্রিপ মানচিত্র স্বাক্ষরিত হয়, আর কাজের পর্যায়ে নানা আলোচনাও চলতে থাকে। গুরুত্বসহকারে ঘন ঘনই এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যবহারিক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ভারতের রাজনৈতিক কারণে এর গতি রোধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী পাস করার জন্য জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেনি। কংগ্রেস নেতৃত্ব আগ্রহী থাকলেও সে সময় বিজেপির আচরণ ছিল রহস্যময়। তার পাশাপাশি এই চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে যেসব রাজ্য জড়িত ছিল, সেসব রাজ্যও বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি গ্রহণ করলে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যেটা বহুদিন ধরেই বকেয়া হয়ে ছিল। তিনি যেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামলেছেন এবং কেন্দ্র ও রাজ্যে অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় পরিবেশেই যেভাবে ব্যাপারটি কৌশলে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, তাতে শেষমেশ এই চুক্তিটি বাস্তব রূপ লাভ করে। পুরো প্রক্রিয়াটা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণেই এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সমাধান লাভ করা সম্ভব হয়েছে। হ্যাঁ, রাজনীতিই, ভূগোলের মর্জি নয়, এই বিষয়টিকে এত দিন এমন অসম্ভব বানিয়ে রেখেছিল।
আমি সব সময় বলেছি, জিইয়ে থাকা সমস্যার সমাধান বের করার মধ্যেই পররাষ্ট্রনীতির সফলতা নিহিত রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ অপরিবর্তনীয় ভূগোল ও ইতিহাসই দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ করে। একদল মানুষ সব সময় থাকবে, যারা যা-ই ঘটুক না কেন, গ্লাসটা অর্ধেক খালিই দেখবে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রাপ্তির জন্য তারা একটা না একটা রাজনৈতিক অজুহাত দাঁড় করায়। এসব শক্তিকে জয় করা এবং বৃহৎ পরিসরের দিকে তাকানোর মধ্যেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃত পরীক্ষা নিহিত রয়েছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব গুণের পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি নিশ্চিতভাবেই জনগণের মধ্যে বড় আস্থা তৈরি করবে। এখন সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে, আর ন্যায্যতার ভিত্তিতে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হলে সম্পর্ক আরও মজবুত হবে, আর তা এমন গতিমুখ পাবে, যা আর কোনো দিন ওল্টানো যাবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
শমসের এম চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব।