ছাত্রী ধর্ষণ: এ বেদনা আমাদের সবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ছাত্রলীগের মেয়েদের মধ্যে যখন সংঘর্ষ হচ্ছে, তার ঠিক একটু পরেই জানতে পারি আমাদের এক ছাত্রীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবরটি। একদিকে দেশে নানাভাবে ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা হচ্ছে, অন্যদিকে ঘরে-বাইরে, পরিবহনে নারীর অনিরাপত্তা ক্রমেই বাড়ছে।

দেশে নারী উন্নয়ন, লিঙ্গীয় সমতার জোয়ার চলছে বলে বারবার দাবি করে আসছে সরকার। কিন্তু দেশে নারী ধর্ষণ বেড়েই চলছে। ব্যক্তিক অর্জন দিয়ে নারী উন্নয়ন মাপা হচ্ছে বলেই আসলে একভাবে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা আড়ালে থাকছে। আর তাতে সুবিধা হচ্ছে ধর্ষকদের। কারণ, তারা জেনে গেছে, ধর্ষণ করলে কয়েক দিন হয়তো হইচই হয়, কয়েক দিন আলোচনায় থাকে, তারপর সেটি অন্য ঘটনার আবর্তে হারিয়ে যায়। মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলেও অধিকাংশ ঘটনারই কোনো শাস্তি হয় না এবং বছরের পর বছর ধরে সেই মামলা চলে বলে নির্যাতিত পক্ষ একসময় হাল ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে কখনো কখনো গ্রেপ্তার হওয়া ধর্ষকেরা জামিন বের হয়ে আসেন, যেমনটা ঘটেছে বহুল আলোচিত বনানী ধর্ষণ মামলার বেলায়। যে ঘটনায় প্রতিবাদ গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়, সেই ঘটনায় কিছু তোড়জোড় দেখা যায়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ওই এলাকা, অর্থাৎ, কুর্মিটোলায় ধর্ষণের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে, বিশেষ করে কদিন আগে সেখানে এক বিউটি পারলারের কর্মীকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, পুনরায় ধর্ষণের ঘটনা থেকে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। যে কারণে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটেছে। ধর্ষকেরা মেয়েটিকে অনুসরণ করেছে এবং তারা দেখেছে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নেমেছে। যেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীই বাস থেকে নামার পর ধর্ষণের শিকার হন, সেখানে অন্য নারীর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমরা শুধু তাঁদেরটাই জানি, যাঁরা সাহস করে প্রতিবাদ করেন এবং মামলা করতে এগিয়ে আসেন। এর বাইরে হয়তো অনেক নারীই এই ধরনের সহিংসতার শিকার হন, যার বেশির ভাগই আমাদের অজানা। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বেশির ভাগ সময়ই অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং শাস্তির জন্য জনগণকে রাস্তায় আসতে হয়; সেই আসা রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে একটু নড়াচড়া করায় কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রই বিচার নিশ্চিত হয়।

ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হওয়ারই কথা। মেয়েটির কথা ভাবতেই পারছি না, কী ভীষণ শারীরিক এবং মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে। তবুও আমার প্রিয় ছাত্রীটিকে বুক জড়ানো মমতা মেখেই বলছি, ‘তুমি বিচার পাবে কি না, আমরা হয়তো নিশ্চিত নই, রাষ্ট্র তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, তুমি আক্রান্ত হয়েছো, তোমার শারীরিক-মানসিক যে ক্ষতি হয়েছে, তার কোনোটিই আমরা মুছতে পারব না, কিন্তু আমরা তোমার পাশেই আছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তোমাকে আগলে রাখবে। মনে রেখো, তোমার যেকোনো মানসিক কষ্ট বুকে পেতে নিতে শিক্ষক হিসেবে আমরা প্রস্তুত আছি এবং আমরা প্রতিবাদ করে যাব।’

সরকারের প্রতি বলতে চাই, শুধু দেশে নারীর ব্যক্তিক অর্জন দিয়ে নারীর অবস্থা বিবেচনার পাশাপাশি নারীর ঘর এবং বাইরে নারীর নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিন। নারীর অনিরাপত্তা এবং নিপীড়ন যে ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে, সেসবের বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে অতি দ্রুত করা যায়, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নিন। শুধু নারীর ওপর দোষ চাপিয়ে কিংবা নারী নিপীড়ন বন্ধে নারীকেই কৌশল শিখিয়ে ধর্ষণসহ অন্যান্য নারী নিপীড়ন বন্ধ করা যে যায় না বা যাবে না, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে কোনো ধরনের পদক্ষেপ কেন সরকার নিচ্ছে না? ঘটনা ঘটার পর শাস্তির ঘোষণা কি ঘটনা রোধ করার জন্য যথেষ্ট? ঘটনা ঘটার পর শুধু বিচারই নয়, এটি যেন বন্ধ করা যায়, সেই বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সময় এখনই।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com