ছাত্রদলের বিদ্রোহী নেতা-কর্মীদের চেয়ে ছাত্রলীগের বিদ্রোহী নেতা-কর্মীরা নিজেদের ভদ্র ও সহিষ্ণু দাবি করতে পারেন। তাঁরা এখন পর্যন্ত আইন ভাঙেননি। কারও ওপর হামলাও করেননি। বরং পদবঞ্চিতরা হামলার শিকার হয়েও সব অপমান ও অপবাদ মুখ বুজে সহ্য করেছেন, করছেন।
অন্যদিকে আগের কমিটি বিলুপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গে ‘আমরা শক্তি আমরা বল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’ বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেছে, নেতাদের হেনস্তা করেছে, অফিস ভাঙচুর করেছে। অফিসের বিদ্যুতের সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সর্বশেষ খবরে দেখলাম, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অফিসে ডিম ছুড়ে মেরেছেন। এর আগে অফিসের সামনে ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছিল।
দুই সংগঠনের বিদ্রোহী নেতা-কর্মীদের আচরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ছাত্রলীগের বিদ্রোহী বা পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই আন্দোলন করছেন। এত দিন তাঁরা অবস্থান ধর্মঘটে ছিলেন। শুক্রবার চার দফা দাবিতে ‘ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা’ আমরণ অনশন শুরু করেছেন। তাঁদের চার দফা হলো আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ, পদ শূন্য ঘোষিত ছাত্রলীগের কমিটির ১৯ জনের পদসহ নাম প্রকাশ, বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে পদবঞ্চিতদের মধ্য থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে কমিটিতে পদায়ন এবং মধুর ক্যানটিনে (১৩ মে) ও টিএসসিতে (১৯ মে) তাঁদের ওপর হামলার সুষ্ঠু বিচার।
ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি প্রকাশের প্রায় ১০ মাস পর গত ১৩ মে সংগঠনের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। আর এ নিয়েই যত বিপত্তি। কমিটি ঘোষণার দিন সন্ধ্যায় কমিটিতে পদবঞ্চিতরা মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা তাঁদের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েকজন নারী নেত্রীসহ ১০ থেকে ১২ জন আহত হন। পরদিন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে গণভবনে ডেকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে বিতর্কিত নেতাদের বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন সংবাদ সম্মেলন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করা হবে বলে জানান এবং ১৬ জনের নাম প্রকাশ করেন । অন্যদিকে পদবঞ্চিতরা ‘বিতর্কিত’ ও ‘অযোগ্য’ ৯৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেন।
১৯ মে টিএসসিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের হাতে ফের মারধরের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন পদবঞ্চিতরা। এক দিনের মাথায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আশ্বাসে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে আসেন। পরের দিন মধুর ক্যানটিনের ঘটনায় পাঁচজনকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। বহিষ্কৃত হওয়ার দুঃখে রাতেই জারিন দিয়া নামের এক নেত্রী ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর থেকেই ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে সরগরম আলোচনা চলছিল। দলের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করলেন, শিগগিরই ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বিরোধ মিটে যাবে। কিন্তু পদবঞ্চিতদের আমরণ অনশন কর্মসূচিতে মনে হচ্ছে, বিরোধ মেটেনি।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে। শিরোনাম ছিল, ‘ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে অভিযোগ: আছে শিবির, ছাত্রদল, মাদকাসক্ত সবই’। এতে বলা হয়, ‘৩০১ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন মাদকাসক্ত, বিবাহিত, বহিষ্কৃত, মামলার আসামিসহ বিতর্কিত অনেকে। ছাত্রলীগের একাংশ নতুন কমিটির ১০৭ জনের বিরুদ্ধে এমন নানা অভিযোগ তুলেছে। কমিটিতে বিতর্কিতদের জায়গা হওয়ার পেছনে আর্থিক লেনদেন ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের মুখপাত্র ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছাড়া বিতর্কিতরা কমিটিতে কোনোভাবেই জায়গা পেতেন না। এখানে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে।’ (২৭ জুন, ২০১৯ প্রথম আলো)
তবে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁরা সবাই ছিলেন সদ্য সাবেক কমিটির (সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন) আস্থাভাজন। পদ-পদবি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় তাঁরা তখন অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ অনুযায়ী, কমিটিতে যে ১০৭ জন ‘বিতর্কিত’ স্থান পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২৫ জন বিবাহিত (ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে বিবাহিতদের নেতা হওয়ার সুযোগ নেই), ১৯ জনের পরিবার সরাসরি বিএনপি কিংবা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ১১ জন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ৮ জন বিভিন্ন মামলার আসামি, ৬ জন ব্যবসায়ী, ৩ জন বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত, ২ জন ছাত্রলীগ থেকে আগে বহিষ্কৃত, ৬ জন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা, ৬ জন চাকরিজীবী বা সরকারি চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত। এ ছাড়া ১৪ জন রয়েছেন, যাঁরা প্রথমবারের মতো সংগঠনে পদ পেয়েছেন। ৭ জন দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার পরও পদবি পেয়েছেন।
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির প্রতিপক্ষ অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন নয়। প্রতিপক্ষ হলো আগের কমিটি। ছাত্রলীগ বরাবর নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন বলে দাবি করে। সাড়ে ১০ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। তারপরও কেন ছাত্রলীগকে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে ‘নেতা’ ভাড়া করতে হবে, এই প্রশ্নের জবাব নেই। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে আছে, সেখানে কোনো বিবাহিত ও চাকরিজীবী থাকতে পারবে না। অথচ কমিটিতে বেশ কজন নেতা আছেন, যাঁরা বিবাহিত ও যাঁদের বয়স ২৯ বছরের বেশি।
সম্প্রতি টেলিভিশনে একটি অনুসন্ধানী খবর দেখেছিলাম, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বিধিতে বলা হয়েছে, ২৮ বছরের বেশি বয়সী কাউকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁর বয়স ৫০ বছরের বেশি। পরে সাংবাদিক যখন নিয়োগ কমিটির প্রধানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা যাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁর বয়স ৫৬ বছর কিন্তু আপনারা কীভাবে তাঁকে নিয়োগ দিলেন?’ জবাবে ভদ্রলোক বললেন, তাঁদের কাছে ২৮ বছরই মনে হয়েছে। কাগজপত্রে সেটাই লেখা ছিল। ছাত্রলীগের কমিটি যাঁরা ঠিক করেছেন, তাঁদের কাছেও যদি ৫৬ বছরকে ২৮ বছর মনে হয় কারও কিছু করার নেই। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হতে হলে বয়স ২৯ বছরের মধ্যে হতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি তানজিল ভূঁইয়ার ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি। আরেক সহসভাপতি সোহেল রানার জন্ম ১৯৮৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। বয়স না থাকার কারণে তিনিও গত বছর মনোনয়ন নিতে পারেননি। অথচ এখন তিনি সহসভাপতি পদ পেয়েছেন।
ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম হত্যা মামলাসহ ছয়টি মামলার আসামি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি খালিদ হাসান ওরফে নয়ন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি এখন সহসভাপতির পদবি পেয়েছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হয়েছিলেন সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য আবু সাঈদ আকন্দ। বর্তমান কমিটিতে তিনি সহসভাপতি। আবু সাঈদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের রোষানলে পড়ায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমাদের ধারণা ছিল, ছাত্রলীগের রোষানল শুধু বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর পড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে, নিজ সংগঠনের মধ্যে যাঁরা অপছন্দের, তাঁদের ওপর অনল বর্ষিত হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত ১২ মে নকলে বাধা দেওয়ায় পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজের এক প্রভাষককে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগ আয়োজিত কনসার্টে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া অর্থের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গত ১২ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে কনসার্ট স্থলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তার আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে ঢুকে তাঁর ওপর ময়লা দিয়ে হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ৬০ লাখ টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়।
ছাত্রলীগের যেই নেতৃত্ব ডাকসুর কনসার্ট নিয়ে মারামারি করে, যাঁদের অনুসারীরা কর্মচারী নিয়োগের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান, সেই নেতৃত্ব কীভাবে সংগঠনকে নেতৃত্ব দেবে?
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনকারীরা কখনো ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে ছিল না। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করেছে। এই নেতার ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। তাঁর কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে মানতে হবে ছাত্রলীগের আগের কমিটি ছিল একটি সিন্ডিকেট এবং তারা ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে ছিল না।
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি যখন সাবেক হবে, তখনো যে এই কমিটির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠবে না, এর নিশ্চয়তা কী?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
ই-মেইল: sohrab.hassan@prothomalo.com