মতামত

ছাত্রনেতা থেকে চিলির প্রেসিডেন্ট, বোরিকের সামনে যে অগ্নিপরীক্ষা

চিলির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক
ছবি : রয়টার্স

সমালোচকদের কাছে চিলির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক ‘কমিউনিস্ট’ তকমা পেয়েছেন। কিন্তু তরুণ এই বামপন্থী নেতা ইউরোপের দেশগুলোর মতো চিলিকে একটি ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান। চিলি বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রগুলোর একটি। জাতিসংঘ সংস্থা ইকোনমিক কমিশন ফর লাতিন আমেরিকা অ্যান্ড ক্যারাবিয়ানের (ইসিএলএসি) তথ্য অনুসারে, চিলির সবচেয়ে ওপরের দিককার ১ শতাংশ মানুষ দেশটির ২৫ শতাংশের বেশি সম্পদের মালিক।

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্য অনুসারে, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে পরিবারপ্রতি আয়ের দিক থেকে চিলি দ্বিতীয় বৈষম্যপূর্ণ দেশ। ২০১৯ সালে দেশটিতে যে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল ধনী ও গরিবের মধ্যে এই সমুদ্রসম ব্যবধান। সে সময়কার বিক্ষোভে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয় এবং দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যাঁদের কাছে ছিল, তাঁরা সরে যেতে বাধ্য হন।

সাবেক ছাত্রনেতা বোরিক ওই বিক্ষোভে সমর্থন দিয়েছিলেন। এখন তাঁর সামনে সুযোগ এসেছে চিলিকে বদলে দেওয়ার। চিলিকে কীভাবে বদলাতে চান, সে ব্যাখ্যা করে বোরিক বলেছেন, ‘ইউরোপের আদলে একটা সমাজ গড়াই আমাদের লক্ষ্য। আমরা একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়তে চাই, যাতে কারও কাছে কত টাকা থাকবে, সেটার অধিকার সবার জন্য সমান থাকে।’ চিলির অপেক্ষাকৃত ধনী এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অনেকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর জোটকে অবিশ্বাসের চোখে দেখেছেন। আবার বিনিয়োগকারীরা তাঁর কর বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিকে ভালো চোখে দেখছেন না। চিলির অনেক নাগরিকের কমিউনিস্টদের নীতি নিয়ে গভীর ভীতি আছে। ভেনেজুয়েলার অনেক নাগরিক এখন চিলিতে অভিবাসী হয়ে এসেছেন এবং দেশটির খারাপ পরিস্থিতির জন্য কমিউনিস্ট নীতি দায়ী বলে মনে করেন চিলির অনেকে।

নির্বাচনে জয়ের পর, সামাজিক অধিকার বাড়ানোর ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন বোরিক। তবে সেটা তিনি করতে চান রাজস্ব আয় ও সরকারের ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করেই। তিনি বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিকে রক্ষা করেই আমরা এটা করব।’ তবে তাঁর এই বক্তব্য বিনিয়োগকারীদের সন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হয় না। ভোটের ফল ঘোষণার পরদিন সান্তিয়াগো স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ৬ দশমিক ৮ শতাংশ পতন হয়। মার্কিন ডলারের বিপরীতে চিলির পেসোর মুদ্রামান রেকর্ড পরিমাণ অবনমন হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আরও বড় অভিঘাত আসছে।

ডিয়েগো পোট্রালেস বিশ্ববিদ্যায়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রদ্রিগো স্পিনোজা মনে করেন, বোরিক প্রথাগত বামপন্থীদের তুলনায় আরও বেশি বাম। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ভেনেজুয়েলা কিংবা বলিভিয়ার বামপন্থীদের চেয়ে তাঁর অবস্থান ভিন্ন। তাঁর অবস্থান ইউরোপের সামাজিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। বোরিকের জোটের নাম অ্যাপ্রুভ ডিগনিটি। তাঁর মতাদর্শ অনেকটাই মধ্যপন্থী। এই জোটে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে কমিউনিস্ট পার্টির ডেনিয়েল জাদুকে পরাজিত করেছিলেন তিনি। স্পিনোজা বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে বোরিক ভুয়া সংবাদভিত্তিক প্রোপাগান্ডার শিকার হন। তাঁকে চিলির হুগো চাভেজ বলে আক্রমণ করা হয়েছে। বোরিক ‘চিলিজুয়েলা’র আওয়াজ তুলেছেন, এ রকম মিথ্যা অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, বোরিকের কর্মসূচিতে ‘মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ ভাঙার কোনো বিষয়ই নেই।

নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কট্টর ডানপন্থী রক্ষণশীল নেতা জোসে অ্যান্তোনিও কাস্ত। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থক এই নেতা বোরিককে কমিউনিস্ট হিসেবে অভিযোগ তোলেন। তাতে তিনি বেশ সুবিধাও পান। কাস্ত তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেন, ‘বামপন্থীরা শুধু দারিদ্র্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও কিউবার মতো দারিদ্র্য। ওই দেশগুলো থেকে মানুষেরা পালিয়ে আসছে।’ কাস্তের এই বক্তব্য অনেক ভোটারের ওপর প্রভাব ফেলে।

গত রোববারের নির্বাচনে বোরিক ১০ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু কাস্ত ৮৩ লাখ ভোটের মধ্যে ৩৬ লাখ ভোট পেয়েছেন। সান্তিয়াগোর অধিবাসী রিকার্ডো সেপুলভেডা। ৭৫ বছর বয়স্ক একসময়ের এই নির্মাণশ্রমিক এবারের নির্বাচনে কাস্তোকে ভোট দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কমিউনিস্ট শাসন...আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার সবকিছুতেই প্রভাব ফেলেছিল।’

চিলির অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সেসকো কাস্তানেদা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, বোরিক কমিউনিস্ট নন। তাঁর রাজনৈতিক জোটকে এটা শিখতে হবে যে রাজস্ব আয় ও সরকারের ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বৈষম্য কমাতে যে সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন, সেটা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। ধাপে ধাপে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে।

নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নির্বাচনের আগে বোরিক এএফপিকে বলেছিলেন, চিলির মতো একটা বহুধাবিভক্ত সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্য করা কিংবা দেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, সবুজ উন্নয়নের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৪৫ থেকে কমিয়ে ৪০ ঘণ্টা করবেন। ৫ লাখ নারীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। তিনি চিলির অবসর ভাতার ব্যবস্থাও বদলাতে চান। ২০১৯ সালের বিক্ষোভের অন্যতম দাবি ছিল এই বিষয়।

নির্বাচনে জয়ের পর, সামাজিক অধিকার বাড়ানোর ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন বোরিক। তবে সেটা তিনি করতে চান রাজস্ব আয় ও সরকারের ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করেই। তিনি বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিকে রক্ষা করেই আমরা এটা করব।’ তবে তাঁর এই বক্তব্য বিনিয়োগকারীদের সন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হয় না। ভোটের ফল ঘোষণার পরদিন সান্তিয়াগো স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ৬ দশমিক ৮ শতাংশ পতন হয়। মার্কিন ডলারের বিপরীতে চিলির পেসোর মুদ্রামান রেকর্ড পরিমাণ অবনমন হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আরও বড় অভিঘাত আসছে।

চিলির এই তরুণ প্রেসিডেন্ট যদি সেখানকার নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক মডেলে মৌলিক কোনো বদল আনতে চান, তবে সেটা তাঁর জন্য খুব কঠিনই হবে। কেননা, আইনসভায় বাম ও ডানপন্থীদের সংখ্যা সমান। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারিয়া ক্রিস্টিনা এসকুডেরোও ভেনেজুয়েলা কায়দায় সমাজতন্ত্রের ধারণা বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, বোরিক নিজের অ্যাপ্রুভ ডিগনিটি জোটের বাইরে বড় জোট গড়ার চেষ্টা করছেন। কেননা, আইনসভার সম্মতি ছাড়া তাঁর সরকারের পক্ষে কোনো কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

বোরিককে তাঁর কর্মসূচি পাস করাতে হলে নিজের জোটের বাইরেও মধ্য-বামদের প্রতিটি ভোট প্রয়োজন। এর মানে, কাউকে বাদ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সবকিছু মিলিয়ে অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি।

আলবার্তো পেনা ও লরেন্ট আবাদি এএফপির সাংবাদিক
ইংরেজি থেকে অনূদিত, এএফপি থেকে নেওয়া