রোজা লুক্সেমবার্গ- জার্মানির ডাকসাইটে সমাজতন্ত্রী ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। জার্মানির পুলিশ ও গোয়েন্দারা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় আটকের পর তাঁকে খুন করেছিল। সমাজতন্ত্রী হলেও লেনিনের বলশেভিক বিপ্লবের পর বিরোধীদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছিল, তার ঘোরতর সমালোচক ছিলেন তিনি। রোজা মনে করতেন, স্বাধীনতা সব সময় এবং স্বাধীনতা একচেটিয়াভাবে তাঁদের জন্য, যাঁরা ভিন্নভাবে ভাবেন। রোজা লুক্সেমবার্গের স্মরণে পশ্চিমবঙ্গের কবীর সুমন ‘বিরোধীদের বলতে দাও’ শিরোনামে একটি গান গেয়েছেন। সেই গানের একটি লাইন হলো, বিরোধীর স্বাধীনতায় স্বাধীনতা বলে সাব্যস্ত হোক।
বাংলাদেশে বিরোধী মত দমন ও বিরোধী চিন্তার ওপর আক্রমণের মহোৎসব চলছে। রাজনৈতিক পরিসর কিংবা জনপরিসর হোক, শারীরিক কিংবা সাইবার পরিসরে হোক—সবখানেই সেটা সমানতালেই চলছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা যে সুস্পষ্টভাবে ফৌজদারি অপরাধ, সেটার স্বীকৃতি কোথাও নেই। বরং যারা মার খাবে, যারা হেনস্তার শিকার হবে, তাদের বিরুদ্ধেই উল্টো মামলা হবে, হয়রানি করা হবে নানাভাবে। জোর যার মুল্লুক তার—এ রকম গায়ের জোরের প্রদর্শন প্রচেষ্টা সবখানেই। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা এ ধরনের ‘গ্রাম্যতা’র চর্চাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রীতিতে পরিণত করেছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এর চর্চা হয়ে আসছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যতিক্রমহীনভাবে একই চর্চা চলমান আছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর দেড় বছর। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নামার কারণ যে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই, সেটা দুই দলের নেতাদের বক্তব্য থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে। ছাত্রসংগঠন, যুব সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ, বিএনপির লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু কেউই প্রশ্নটা করছে না, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের এভাবে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা, পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়াটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কতটা নৈতিক।
অথচ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল করার অধিকার, পোশাকের স্বাধীনতা—প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার। কিন্তু কাজির গরু কেতাবের মতোই সেটা সংবিধানের বিষয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে চর্চা না থাকায় সমাজের নানা স্তরে এর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভয়াবহ। ফলে ভিন্ন ধরনের পোশাক কেউ পরছে বলে প্রকাশ্যে রেলস্টেশনে নারীর ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরোধী দল বিএনপির ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা যাতে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বেপরোয়াভাবে পিটিয়ে আহত করেছেন।
গণমাধ্যমের খবর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দলবদ্ধভাবে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে আহত করা হচ্ছে। এটাকে নৃশংসতা বললে কম বলা হবে। কদিন আগেই নিউমার্কেটে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেছিল দুজন দোকান কর্মচারীকে। গত সপ্তাহে ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে সেই একই কায়দায় পেটাতে দেখলাম। এমনকি ছাত্রদলের নারী কর্মীরাও বেপরোয়া পিটুনির হাত থেকে রক্ষা পাননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের বড়াইও করতে দেখলাম। আবার এ নৃশংসতাকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লাশ ফেলার ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি’ এমন বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ন্যায্যতা দিতেও দেখলাম।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর দেড় বছর। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নামার কারণ যে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই, সেটা দুই দলের নেতাদের বক্তব্য থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে। ছাত্রসংগঠন, যুব সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ, বিএনপির লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু কেউই প্রশ্নটা করছে না, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের এভাবে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা, পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়াটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কতটা নৈতিক। রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়েরা কেউ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না, তাই শিক্ষার্থীদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে তাদের দ্বিধা নেই।
দেশে এখন মূল্যস্ফীতিসহ জনজীবনে অসংখ্য সংকট চলছে। খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা থাকছে না। শিক্ষার পরিবেশ, খাবারের মান, শিক্ষাজীবন শেষে বেকারত্ব কিংবা ভালো চাকরি না পাওয়া—এ রকম হাজারো সংকট আছে শিক্ষার্থীদের। জনজীবনের কোনো সংকট কিংবা শিক্ষার্থীদের কোনো সংকট এখন আর আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের মতো সংগঠনের নেতাদের কাছে ইস্যু নয়। কর্মসংস্থান হীনতার এ দেশে রাজনীতিই এখন সবচেয়ে লোভনীয় কর্মসংস্থান। ফলে দেশ ও মানুষকে নিয়ে ভাবনার বদলে, এক দলের কাছে ‘নেত্রীকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে’, অন্য দলের কাছে ‘নেত্রীকে কটূক্তি করা হয়েছে’, এমন অভিযোগই একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
এ মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগের নীতি সর্বোচ্চ নির্ধারণী পর্যায় থেকে বিরোধী দলের মিছিল-সমাবেশে বাধা দেওয়া হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ যেভাবে ছাত্রদলের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের নেতাদের ইঙ্গিত সেখানে রয়েছে। ক্যাম্পাসগুলাতে ছাত্রলীগ এক যুগের বেশি সময় ধরে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে আসছে। যদিও মাঝেমধ্যে বাম প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থী নিপীড়নসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নানা অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। তবে তাঁরা সংখ্যায় এত কম যে ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও সেসব আন্দোলন খুব সহজেই দমন করা হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন যে থাকতে পারে, সেই ধারণাটিই এখন সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে অনুপস্থিত। ফলে ভিন্নমতের যে কেউ তাঁদের কাছে দমনযোগ্য মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমন যুক্তি দিতেও দ্বিধা করেননি, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার স্বার্থে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রদলের ‘সন্ত্রাসবাদী’ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, সেই দায়িত্ব ছাত্রলীগকে কেউ দেয়নি। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, আরেকটা গণতান্ত্রিক দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ কার্যক্রম হিসেবে তকমা দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগ এ যুক্তি কোথায় পেল? এ ধারণার বিপদ অনেক। এর অর্থ পরিষ্কার, ‘হয় তুমি আমার পক্ষে, না হয় তুমি সন্ত্রাসবাদী’। আরও বড় পরিসরে ভাবলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘সহমত ভাই হও’, ভিন্নভাবে চিন্তা করলেই তোমাকে দমন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলা বিরোধী মত দমনের বহিঃপ্রকাশ– বামপন্থী আটটি ছাত্রসংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা বলেছে। তাদের এ দাবি যথার্থ। শুধু সাম্প্রতিক হামলা নয়, এর শিকড় আরও গভীরে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর থেকেই ভিন্নমত দমনের এই চর্চা শুরু। বিএনপির শাসনামলেও সেটি চরমভাবে হয়েছে। কিন্তু গত এক যুগে তার ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুগুণ।
একটা সমাজে, রাষ্ট্রে মত, পথ, দর্শন, চিন্তার ভিন্নতা থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তিই হচ্ছে বিরোধী মতের ওপর সম্মান দেখানো। সেটা শর্ত নিরপেক্ষভাবে হতে হবে। বিরোধী মত দমনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনেরা সাময়িক লাভ পেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তাতে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে মত, যে পথ, যে দর্শনের হোক বিরোধীকে বলতে দিতে হবে। আমরা এমন এক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক পরিসর চাই, যেখানে বিরোধীদের স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
monoj.dey@prothomalo.com