দিন বদলায় কিন্তু তারুণ্যের একটি গুণ অপরিবর্তিত থেকে যায়। ওঁরা নির্ভীক। যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশ ও দশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে ওঁরা দ্বিধা করেন না। এর প্রমাণ আমরা বারবার দেখেছি। গণজাগরণ মঞ্চ, নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থান, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সব সময় তরুণেরাই সামনের সারিতে। দেশবাসীর সঙ্গে অকাতরে জীবন দিয়ে গেছেন কত তরুণ।
ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। কিন্তু সময়ের ডাকে সাড়া দিতে তরুণেরা ভুল করেন না। মনে পড়ে একাত্তরের অক্টোবরের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। খুব সকালে হাজারখানেক কিশোর-তরুণ সমবেত হয়েছেন। ভারতের শিলিগুড়ি রেলস্টেশনের সামনের প্রশস্ত চত্বরে। বেশ কয়েকটি সেনা ট্রাক অপেক্ষা করছে। বাছাই করা তরুণদের নিয়ে যাবে গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য। আমরা প্রতি মাসেই এক ব্যাচ করে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিংয়ে পাঠাই। আসামের দুর্গম অঞ্চল তেজপুরে এক মাসের সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং। এরপর বর্ডার পার করে ওঁদের দেশের ভেতরে পাঠানো হয়। এই ইনডাকশনের কাজটা বেশ কঠিন। ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তুতি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ওঁরা দেশের ভেতর বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করেন।
বাংলাদেশের ভেতর থেকে তরুণেরা দলে দলে আসতেন আমাদের ক্যাম্পগুলোতে। তাঁদের চোখে–মুখে আগুন। মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে ওঁরা অপেক্ষা করতেন। কবে সময় হবে। তাঁদের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে। তারপর সরাসরি যুদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুরের পাটন, বালুরঘাট, দিনহাটা, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি এলাকায় আমাদের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। মূলত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, তেঁতুলিয়া প্রভৃতি এলাকার তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য আমাদের ক্যাম্পগুলোতে দল বেঁধে চলে আসতেন। প্রাথমিক আদর্শগত প্রশিক্ষণের পর তাঁদের পাঠানো হতো ট্রেনিংয়ে। সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন পরিচালিত এই বিশেষ গেরিলা ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে ছিলেন দিনাজপুরের প্রবীণ নেতা কমরেড গুরুদাশ তালুকদার, তেজেন নাগ, বগুড়ার মোখলেস ভাই, ছাত্রনেতা শামসুদ্দোহা ভাই, ওয়াজেদ ভাই, আমিসহ আরও কয়েকজন। মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা ও প্রাথমিক কিছু সামরিক ট্রেনিং আমাদের ক্যাম্পে হতো। সামরিক ট্রেনিংয়ের কাজে মাঝেমধ্যে ভারতীয় সেনা ক্যাম্পের সদস্যদের সহায়তা পেতাম। ওঁরা নিজ থেকেই এসে আমাদের প্রশিক্ষণে সাহায্য করতেন। এরপর সেই টগবগে তরুণদের পাঠানো হতো তেজপুর।
সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে ওঁরা আসতেন। একেক দলে থাকতেন ১০-১৫ জন করে তরুণ। এসে বলতেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে হবে।’ বলতেন, ‘আমরা কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি।’ আমরা বলতাম, কী দেবে তোমরা? এক কাপড়ে চলে এসেছ! তাঁরা বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘দেব আমাদের জীবন। দেশের জন্য জীবন দেব। দেশকে মুক্ত করব।’ ওঁরা একদম গ্রামের তরুণ। সামান্য পড়াশোনা আছে হয়তো। কিন্তু দেশপ্রেমে ওঁদের তুলনা হয় না। আর আছে অসামান্য সাহস ও দৃঢ়তা। কোনো কিছুকেই পরোয়া করেন না। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বুঝতে চান না।
আমাদের ক্যাম্পটা ছিল পাটন গ্রামের এক প্রান্তে। এটা পশ্চিম দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর থেকে মাইল তিনেক দূরে। বর্ডার থেকে মাইল পাঁচেক হবে। প্রতি রাতে সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের গোলাগুলি শোনা যেত। ক্যাম্পের তরুণেরা অস্থির হয়ে উঠতেন। বলতেন, ‘আমাদের শিগগিরই ট্রেনিংয়ে পাঠান। পাকিস্তানি বাহিনী তো মার খেয়ে পালাচ্ছে।’
বলতাম, ‘তোমরা জানো কীভাবে? ওই সব দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী তো এত সহজে ছেড়ে দেবে না।’
ওঁরা বলতেন, ‘খবর পাই। এই তো গতকাল গ্রামের ছেলেরা এসেছে। বলল, পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত থেকে ভেতরের দিকে ভেগে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর মার খেয়ে পালানোর পথ পাচ্ছে না। তখন সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। আমরা টের পাচ্ছিলাম, বিজয় দোরগোড়ায়।’
একবার সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনলাম। পরদিন গঙ্গারামপুরের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এক জিপভরা কমলালেবু আমাদের জন্য এনে বললেন, আজ আনন্দের দিন। গত রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের মার খেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা সীমান্তের পাঁচ-সাত মাইল ভেতরে পালিয়ে গেছে। ওদের অনেক লাশ ফেলে গেছে। আমরা সেদিনটি উদ্যাপন করলাম বটে। কিন্তু দেশের ভেতরে যে আমাদের মা-বাবা, ভাইবোনদের ওপর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী অত্যাচার করছে, নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, সে কথা ভেবে সেদিন আনন্দের মধ্যেও বিষাদের ছায়াপাত ঘটেছিল। এ রকম সময়ে একদিন আমরা শিলিগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জন্য নিয়ে গেছি। শুরুতে সে কথা বলছিলাম। আমরা ভাবছি, দুদিন পর যে ব্যাচটা ট্রেনিং শেষে ফিরে আসবে, তাদের জন্য নতুন পরিকল্পনা করতে হবে। এই সময় একটু দূরে হইচই শুনে এগিয়ে গেলাম। সেনা ট্রাক থেকে এক কিশোরকে জোর করে নামিয়ে দিচ্ছে ওরা। কিন্তু সেই কিশোর কিছুতেই নামবে না। সে বলছে, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবই। আমাকে যেতেই হবে। যুদ্ধ না করে আমি গ্রামে ফিরে যেতে চাই না।’
আর সেনাসদস্যরা বলছেন, ১৬ বছর না হলে ট্রেনিংয়ে নেওয়া যাবে না। এটা নিয়ম। এই নিয়ম ভাঙার ক্ষমতা আমাদের নেই। সেই কিশোরের বয়স ১৪-১৫ হবে। তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে দেওয়ামাত্রই সে দৌড়ে পাশের ট্রাকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল! সেখানেও একই অবস্থা। সেনারা তাকে কিছুতেই নিতে চাইছেন না। তাকে নামিয়ে দিলেন। কিন্তু কাজ হলো না। পরমুহূর্তেই সে পাশের আরেকটি ট্রাকে গিয়ে উঠল। ওদিকে ১০-১৫টা ট্রাক থেকে সবাই হইচই শুরু করে দিয়েছে। কারণ, ওই কিশোরের তিন-চারজন সমবয়সী বন্ধু ছিল বিভিন্ন ট্রাকে। ওরা হয়তো কমান্ডারের চোখ এড়িয়ে ট্রাকে উঠে পড়েছিল। কিন্তু যখন দেখল তাদের বন্ধুকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন আর চুপ থাকল না। একটানা প্রতিবাদ শুরু করে দিল।
সে এক অভাবনীয়, অপূর্ব দৃশ্য! দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য জীবন দিতে চায়, কিন্তু প্রচলিত আইন তাদের আত্মত্যাগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা তো হতবাক। এ রকম সমস্যায় আগে কখনো পড়িনি। এগিয়ে গেলাম। কমান্ডারের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ওদের আবেগ-আগ্রহ-দেশপ্রেমকে মর্যাদা দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ওরাও গেল ট্রেনিংয়ে।
মুক্তিযুদ্ধে অনেক ঘটনা আমাদের মন ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ছিল অন্য রকম দিন। আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান। জানি না, তেঁতুলিয়ার সেই তিন–চার কিশোর এখন কোথায়। নিশ্চয়ই তারা এখনো দেশ ও দেশের মানুষের পাশেই আছে। আজ মাঝ বয়সেও তাঁরা নিশ্চয়ই তারুণ্যের উদ্দীপনা ধরে রেখেছেন।
আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com