বিদায়ী বছরটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তেমন উত্তাপ না ছড়ালেও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে রেখে গেছে। চ্যালেঞ্জটি এসেছে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে। বছরের শেষ দিকে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী
নিজের মাতৃভূমি থেকে নির্যাতিত ও উৎখাত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এদের স্বদেশভূমিতে ফিরে যাওয়া। নতুন বছর ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা বিষয়ে শুধু অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকতে হবে।
২০১৭ সাল বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে আরও অনেক গুরুতর চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে, যেগুলো এ বছর এবং তারও পরে জাতির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে। আমার মনে হয়, ক্রমেই এক অন্ধকারের মধ্যে আমরা প্রবেশ করছি। বিগত কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, আমাদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে পঙ্গু করতেই সুপরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আক্রমণ ভেতর ও বাইরে-দুই জায়গা থেকে হচ্ছে বলে মনে হয়। আক্রমণ হচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজের ওপর মাদক নামক হাতিয়ারের ব্যবহারের মাধ্যমে। আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে অর্থনৈতিক অঙ্গনে ব্যাংক লুট আর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচারের মাধ্যমে। কত হাজার কোটি টাকা এ পর্যন্ত পাচার হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো নির্লজ্জভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে।
ওপরের দুটি অঙ্গন ছাড়াও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন। বাঙালি সংস্কৃতি প্রায় ধ্বংসের পথে অবাধ আকাশ সংস্কৃতির কারণে। এর ছাপ ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনে। চতুর্থ লক্ষ্যবস্তু, যা মাত্র কয়েক বছরে আতঙ্কিত হওয়ার মতো বাড়ছে, তা হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গন।
২০১৮ সালের শুরু থেকেই চারদিকে হইহই রব আগামী নির্বাচন নিয়ে। আমি নিজেও প্রায় প্রতিদিন এ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। মনে হয় নির্বাচন ছাড়া ২০১৮ সালে আমাদের সামনে আর কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। মনে হয় নির্বাচন হলেই আমাদের জাতীয় জীবনের চলমান ও আসন্ন সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। আর নির্বাচন মানেই আমরা উদার গণতান্ত্রিক দেশের তকমা পেয়ে যাব। আমাদের দেশে শুধু নির্বাচন নিয়ে যেভাবে সবাই মেতে থাকেন, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিরল।
২০১৮ সাল কেমন যাবে, তা নিয়ে জ্যোতিষী থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রের বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লেখালেখি, টক শো ও গোলটেবিল বৈঠকে তা তুলে ধরছেন। সবার একই বিষয়-আগামী নির্বাচন। অবশ্যই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় জীবনে হয়তো দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য না হলে বাংলাদেশের জন্য যে মঙ্গল বয়ে আনবে না, তাতে সিংহভাগ মানুষ মোটেও সন্দেহ পোষণ করেন না। তবে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম, সেগুলো যে ভবিষ্যতে জাতির মেরুদণ্ড ভাঙবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
আমার মনে হয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধস নেমেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে কয়েক প্রজন্মকে এর এমন শিকার হতে হবে যে সেখান থেকে বের হওয়া দুরূহ হবে। এমন ব্যাপক মাত্রায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে, তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। এখন প্রথম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার হাজারখানেক স্কুলের পরীক্ষা মাত্র এক দিন আগে বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির। অবিশ্বাস্য বিষয়। ওই দিনই বিবিসিতে সাক্ষাৎকারে একজন বাবা দুঃখ করে বলছিলেন, পরীক্ষা না হওয়ার সংবাদে তাঁর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া পুত্র কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, কী কারণে পরীক্ষা বন্ধ হয়েছে? ভদ্রলোক দুঃখ করে মন্তব্য করলেন, তিনি কীভাবে তার এই কোমলমতি শিশুসন্তানকে বোঝাবেন যে তার ক্লাসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে? বাকি উচ্চশিক্ষার জায়গার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা তো বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি একটি ব্যাংকের প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর পরীক্ষা বাতিল হয়েছিল। কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস। এ বিষয়ে লিখতে গেলে মহাকাব্য হতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিশদ সারগর্ভ আলোচনা করার মতো জ্ঞান আমার নেই, কিন্তু সচেতন এবং একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে অতীতের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করে হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে কোনো এক সংবাদপত্রে সজ্জন বলে বিবেচিত শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ১৯৬১ সালেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো-এ ধরনের কিছু কথা। তিনি ১৯৬১ সালকে কেন বেছে নিলেন জানি না। তবে তাঁর মতো একজন ব্যক্তি, যিনি একসময় বাম রাজনীতির আদর্শে রাজনীতি করতেন, তাঁর মুখ থেকে এমন কথা শুনব বলে আশা করিনি। এর আগে তিনি ঘুষ খাওয়া নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে ঘুষখোর ব্যক্তিরাও চমৎকৃত হয়েছেন। অবশ্য মন্ত্রী মহোদয় এককথায় স্বীকার করেছেন যে ঘুষ এখন আমাদের সামাজিক জীবনে এক ব্যাধির মতো বাসা বেঁধেছে। এর আগে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলেছিলেন যে ঘুষ নয়, স্পিড মানি। অবশ্যই স্পিড মানি।
ঘুষ-বাণিজ্য কম করতে সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন অভূতপূর্বভাবে বাড়িয়েও কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। যাঁরা এ পথের পথিক নন, সেই সব সহস্র কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্যও ঘুষ না খাওয়া একধরনের বিপদ। নিয়মনীতি এবং আইনানুগভাবে কাজ করতেও পদে পদে বাধা। বিনা স্পিড মানিতে কোনো সরকারি কাজ হয়, এ কথা এখন কেউ বিশ্বাসও করতে চায় না। অতীতে ঘুষ শুধু সরকারি পর্যায়েই ছিল, এখন তার বিস্তৃতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বেড়েছে। স্কুল-কলেজে ভর্তি টাকা ছাড়া হয় না, যার নাম ‘ডোনেশন’।
বলছিলাম শিক্ষাব্যবস্থার কথা। ঢাকা শহরেই প্রায় অর্ধশত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। জানি না, বিশ্বে এই আয়তনের আর কোনো শহরে এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে কি না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগের মান নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এমনকি উচ্চশিক্ষায়ও চৌর্যবৃত্তি। পিএইচডি গবেষণাও চৌর্যবৃত্তির আবর্তে।
শিক্ষাব্যবস্থার এহেন অবস্থার সঙ্গে তরুণ সমাজকে আক্রমণের মোক্ষম আরেক হাতিয়ার মাদক এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যদিও তেমন গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, তবে বিভিন্ন তথ্যে জানা যায় যে প্রায় এক কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মাদকের শিকার, যার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ তরুণ। ইয়াবা এখন হাটে-ঘাটে-মাঠে উন্মুক্তভাবে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে এর উৎপত্তি। মিয়ানমার বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাদক উৎপাদনকারী দেশ। ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার এই ব্যবসায়ে উপার্জন। অভিযোগ আছে, ওই দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে বড় বড় বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রধান অর্থ উপার্জনের উপাদান মাদক। ক্রমেই বাংলাদেশেও প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য এই লাভজনক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে।
আমাদের দেশের মাদকের এমন প্রভাব মনে করিয়ে দেয় ঊনবিংশ শতাব্দীর চীনের কথা। ওই সময়ে মাদকের আসক্তিতে চীনের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ একেবারে অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিল। এই আসক্তি ছড়িয়েছিল ওই সময়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতেও। আফিম বাণিজ্যের মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের অনুমতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দুটি বাণিজ্যযুদ্ধও হয়েছিল রাজকীয় চীনা বাহিনীর সঙ্গে। সামরিক ইতিহাসে এ দুই যুদ্ধ চিহ্নিত রয়েছে প্রথম অপিয়াম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২) এবং দ্বিতীয় অপিয়াম যুদ্ধ (১৮৫৬-১৮৬০) নামে। ওই যুদ্ধগুলোর কারণে ওই সময়ে জিং রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হাতছাড়া হয়েছিল হংকংসহ বেশ কয়েকটি বন্দর। মাদকের ওপরে ১৭২৯ সালের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে চীন হয়ে উঠেছিল দখলদারদের রণক্ষেত্র।
বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চীনা সমাজ মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল। এই অবস্থার ভয়াবহ ও সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র পাওয়া যায় নোবেল বিজয়ী পার্ল এস বাকের কালজয়ী উপন্যাস গুড আর্থ-এ। যেসব সুহৃদ পাঠক এমন একটি সাহিত্যকর্ম পড়েননি, তঁারা এই উপন্যাস পড়ে দেখতে পারেন। আমাদের দেশে মাদকের কারণে স্নেহময়ী কন্যা পিতামাতাকে হত্যা পর্যন্ত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ঠিক যেন পার্ল এস বাকের ওয়াং লাই পরিবারের চিত্র। তবে ওয়াং লাই পুত্রদের হাতে নিহত হননি, সর্বস্ব খুইয়েছিলেন বৃদ্ধ বয়সে। সেখানেও ছিল অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের কাহিনি।
জাতীয় জীবনের বাকি দুই আক্রমণের ক্ষেত্র নিয়ে হয়তো অন্য সময়ে বিশদ আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি। তবে এসবই একই সূত্রে গাঁথা। মনে হয় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছকে আমাদের সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার গহ্বরের দিকে তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালকে প্রায় সবাই নির্বাচনের বছর হিসেবেই আলোচনায় রাখতে চাইবেন, কিন্তু ২০১৮ সালে জাতীয় জীবনে যে এ ধরনের দুর্যোগ বাড়বে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমরা এই আক্রমণ কীভাবে মোকাবিলা করব, তা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা খুবই জরুরি। যেমন জরুরি অর্থবহ জাতীয় নির্বাচন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
hhintlbd@yahoo.com