চুল নিয়ে চুলোচুলির চুলচেরা লেকচার

হার্রি আপ ব্রাদার! অ্যাটেনশন প্লিজ! লেকচার আমি দেব না। লেকচার আমি দিতে আসি নাই। তবে ভাইয়া, চুল নিয়ে দেশে যে চুলোচুলি শুরু হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আপনাদের মাঝ থেকে বিদায় নেব। বেয়াদবি হলে জায়গায় দাঁড়িয়ে আওয়াজ দেবেন, জায়গায় গিয়ে মাফ চেয়ে আসব। ভাইয়ারা হাতের এবং বোনেরা চুলের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে এই মজমায় ‘গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হয়ে আসুন সকলে’। প্লিজ লিসেন টু মি—

আইয়ুব খান সাহেবের আমল দেখা হয়নি। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি। সেই ফিল্ড মার্শাল নাকি চুলের ব্যাপারে একচুলও ছাড় দিতেন না। তাঁর পুলিশ বাহিনী বাবরি চুলওয়ালাদের ধরে ধরে অযোধ্যামার্কা সেলুনে ঢুকিয়ে দিত। নাপিত মাথার ওপর বাটি বসিয়ে আর্মি ছাঁট দিয়ে দিত। বেতাড়া বখাটেকে দশ মিনিটে গুডবয় বানিয়ে দিত। যাকে বলে ‘নলের মতো সোজা’। পরের দিন গোসলটোসল করে, মাথায় তেলটেল দিয়ে, বাঁয়ে সিঁথি কেটে ছেলেটি যখন ইশকুল-কলেজে যেত, তখন আইয়ুব খানকে ‘বাপের বেটা’ না বলে কারও উপায় থাকত না।

কিন্তু ব্রাদার, সেটা তো পাকিস্তান পিরিয়ডের কথা। সেটা তো মার্শাল লর যুগ। এখন হোক হিপোক্রেসি, তবু তো ডেমোক্রেসির যুগ। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের যুগ। এই যুগে সিক্স-সেভেনে পড়া বাচ্চারা পর্যন্ত শিশু অধিকার আইন বোঝে। মা–বাপ ধমকধামক দিলে শিশু নির্যাতন আইনের রেফারেন্স দেয়। ছোট ছোট হাতগুলো এখন আইনের হাতের মতো লম্বা। সেই হাতে হাতে স্মার্টফোন। ফোনে ফোনে ফেসবুক। পান থেকে চুন খসলেই ফেসবুকে আবক্ষ স্ট্যাটাস। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মানি না, মানব না।

দাদাভাই, এই জেনারেশনকে পুলিশ যদি দাবড়ানি দেয়, পুলিশ যদি বলে, ‘সালমান খান, জাস্টিন বিবার, কিম জং–উন কিংবা মাহফুজুর স্টাইলে চুল কাটতে পারবা না’, তাহলে কি সেটা ইনসাফ হয়? আপনারাই ফয়সালা দ্যান। খবরে এসেছে, অন্তত আট জেলায় প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষা কর্মকর্তারা ফরমান জারি করেছেন, ‘বখাটে কাট’ দেওয়া যাবে না। তাঁরা মনোজ্ঞ মতবিনিময়ের মাধ্যমে নরসুন্দর সম্প্রদায়কে ‘গুডবয় কাটিং’ দেওয়ার কায়দা-কানুন বাতলে দিয়েছেন। কোথাও কোথাও ‘উরাধুরা’ চুল কাটা নিয়ে কিশোর-তরুণদের যৎসামান্য টাইট দেওয়া হয়েছে। আন্দাজ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি ভব্যতা, কৃষ্টি-কালচার রক্ষার মহান আন্দোলনে পুলিশ বিভাগের কিছু কর্মকর্তাও আত্মোৎসর্গ করেছেন। গত বুধবার পুলিশ বগুড়ার দুটি বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ৩২ শিক্ষার্থীকে আটক করে সদর থানায় নেয়। তাদের দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার পর অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দেওয়া আড্ডাবাজ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সাত দিন শহরজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলবে বলেও পুলিশ ঘোষণা দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের ম্যালা দেশে ‘রিলিজিয়াস পুলিশ’ আছে। তারা ধর্মীয় অনুশাসন না মানলে পাবলিককে ছ্যাঁচা দেয়। উত্তর কোরিয়ায় আছে ‘ফ্যাশন পুলিশ’। তারা দেশটির কৃষ্টি–কালচারবিরোধী ফ্যাশন ঢুকলে তা উপড়ে ফেলে। উত্তর কোরিয়ার ছাত্ররা চাইলেই যেকোনো স্টাইলে চুল রাখতে পারে না। দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের মতো চুল কাটাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্দেশ দেওয়া আছে। চুল কীভাবে কাটতে হবে, দেশটির রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি তার প্রচার চালিয়েছে। দেশটিতে নারীদের জন্য ১৮ ও পুরুষদের জন্য ১০ ধরনের চুল কাটার অনুমোদন আছে। সেলুনে কীভাবে চুল কাটতে হবে, তার ছবিও টাঙানো আছে। বাংলাদেশে সব সেলুনে এই রকমের ক্যাটালগ টাঙিয়ে দিলে নরসুন্দর এবং ছাত্র-পাত্র সবারই সুবিধা হতো।

আগের এক মজমায় চুল নিয়ে একটা গল্প বলেছিলাম। আবার বলি।

সে বছর ‘সড়ক’ ছবির তোড়ে ভেসে ছেলেরা গণহারে সঞ্জুছাঁটে চলে গেল। মেথর থেকে কলেজপড়ুয়া—সবাই। বিষয়টা আমাদের এলাকার আজমাইন দারোগার (লোকে বলত ‘আজরাইল দারোগা’) মোটেও ভালো ঠেকল না। রাস্তাঘাটে বখাটে-বেয়াদবদের তিনি কড়া সাজা দিতেন। গার্লস স্কুলের সামনে কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে ওই স্কুলের গেটে নিয়ে তাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। চড়-থাপ্পড় তাঁর কাছে জলভাত ছিল।

তো আজমাইন দারোগা সঞ্জুছাঁটের সব পোলাপান ধরে ধরে সেলুনে ঢোকাতে লাগলেন। সেলুন থেকে বের হওয়ার পর তাদের চেহারায় ‘ভালো ছাত্র’ ধরনের ‘লুক’ এসে গেল। চুলে নারকেলের তেল দেওয়ার পর তাতে চিরুনি মারতেই মনে হতে লাগল, এই ছেলের মতো সভ্যভব্য গুডবয় আর নাই। ময়মুরব্বিরা বিরাট খুশি। তাঁরা আজমাইন দারোগাকে সংবর্ধনা দিলেন। কিন্তু দেখা গেল, সঞ্জুভক্তদের চুলের দৈর্ঘ্য কমলেও এলাকায় ইভ টিজিং থেকে পাতি মাস্তানি—কোনোটাই আগের চেয়ে কমল না। নতুন ছাঁটে ‘ভালো ছাত্র ধরনের’ লুক পাওয়া সেই ছেলেরাই ইভ টিজিং করে বেড়াতে লাগল। তখন আমরা বুঝলাম, ‘সব বখাটে স্টাইলিশ হয় না, সব স্টাইলিশ বখাটে হয় না।’

তখনকার দিনে হাটে-বাজারে কাঠের পিঁড়িতে বা ইটের ওপর বসে চুল কাটতে হতো। ইট-সম্বল এই নাপিতালয়কে বলা হতো ‘ইটালিয়ান সেলুন’। একটু শহরমতো এলাকায় আগেই সেলুন তৈরি হয়েছে। ‘অভিজাত’ লোকেরা সেখানে চুল কাটত। কী এক রহস্যময় কারণে প্রায় সব সেলুনেই অর্ধেক মানবী অর্ধেক ঘোড়ার একটি ছবি ঝোলানো থাকত। কোনো কোনো সেলুনে এই ছবির নিচে কাগজে সাঁটা বাণী: ‘বগল কামাইয়া দিতে বলিবেন না’। ‘ইটালিয়ান সেলুনে’ চুল কাটার সঙ্গে এই জিনিস ফাউ ছিল। সেখানে চুল–দাড়ি কেটে যাঁদের অভ্যাস, তাঁরা কখনো কখনো এসব সেলুনে ঢুকে যাতে এই অশ্লীল আবদার করে না বসেন, সে জন্য এমন নোটিশ টাঙানো লাগত।

তো, অন্য সব এলাকার মতো আমাদের এলাকায়ও একটা ‘অভিজাত সেলুন’ ছিল। সেখানে রতন শীল ওরফে রতন কাকু ছেলেপেলের কেশ সংস্কার করতেন। রতন কাকু ছিলেন একাধারে জ্যান্ত বিবিসি ও গুগল। এলাকার কার মেয়ে কার ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে, বুশের সঙ্গে সাদ্দামের কী নিয়ে গন্ডগোলের সূত্রপাত, কামরূপ কামাখ্যার কোন আদিবাসীরা গাছের পাতা পরে থাকে, থানকুনি পাতায় আমাশয় ছাড়াও আরও কী কী রোগ সারে—সব রতন কাকু জানতেন। সব তিনি কুট কুট করে বলতেন আর টুক টুক করে চুল কাটতেন। সঞ্জুছাঁটটা তাঁর হাতে খুলত ভালো। ছেলেপেলে তাঁর কাছে এই স্টাইলের জন্য যেত। আজমাইন দারোগার রাগারাগিও তিনি আমলে নিতেন না। কেউ এসে বললেই কাজ করে দিতেন।

হঠাৎ রতন কাকুর সেলুন বন্ধ। শোনা গেল, তিনি যাদের সঞ্জুছাঁটে চুল কেটে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ফুলটাইম বেকারের সঙ্গে তাঁর মেয়ে ভেগেছে। মাস খানিক পর রতন কাকু দোকান খুললেন। যোগ হলো নতুন নোটিশ: ‘এখানে সঞ্জুছাঁট দেওয়া হয় না’।

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin.ahmed@prothomalo.com