কিছুদিন আগেই এক মন্ত্রী বলেছেন, দেশ উন্নত হচ্ছে বলেই নাকি ডেঙ্গু হানা দিয়েছে। এখন আবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুল-দাড়ি কাটার ওপর ‘বিধি-নিষেধ’ আরোপ করছে স্থানীয় প্রশাসন। এর সঙ্গেও কি উন্নতির সম্পর্ক আছে? আসুন, একটু তলিয়ে দেখা যাক।
চুল-দাড়ি একটু ‘স্টাইল’ করে কাটার সঙ্গে ট্যাঁকের উন্নতির একটি সরাসরি যোগসূত্র আছে। মা-বাবার দান বা নিজের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই সাধারণত চুল-দাড়ি কেটে নিজেকে হালনাগাদ করার ইচ্ছা জেগে ওঠে। তরুণদের মধ্যে এভাবে ‘স্টাইল’ করে কিছুটা ‘ভাব’ নেওয়ারও বিষয় থাকে। সেটা তারুণ্যের অবধারিত লক্ষণ। তবে দেশের কিছু এলাকায় সরকারি প্রশাসন এতে বাদ সেধেছে। চুল কীভাবে কাটতে হবে, তা নিয়ে মোট আট জেলায় প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষা কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। কোথাও কোথাও কিশোর-তরুণদের শাসানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে। এমনকি কিছু জায়গায় নাকি নরসুন্দরদের কাছ থেকে ক্যাটালগ সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তও হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয়েছে। কেউ সমালোচনা করছেন, কেউ আবার সমর্থনও করছেন।
প্রশাসন বলছে, তারা ‘বখাটে কাটিং’ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। মাগুরা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) বলেছেন, নাগরিকের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন বা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে নয়, বরং কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন করতে চুলে ‘বখাটে কাটিং’ না দিতে প্রচারণা চালানো হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে বখাটে কাটিংয়ের সম্পর্ক কী? বিষয়টি নিয়ে জানাবোঝার দরকার আছে। এমন কোনো বিষয় আছে যে চুল ‘বখাটে’ ঘরানায় কাটলে অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টি হয়? আমার জানা নেই, সমাজবিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। কলেজজীবনে আমার এক বন্ধু ছিলেন, যিনি একটু স্টাইল করে চুল-দাড়ি কাটতে বেশ আগ্রহী ছিলেন। তবে বন্ধুবান্ধবের পরিমণ্ডলে কথাবার্তার দিক থেকে তাঁর চেয়ে ভদ্রলোক আমি কমই দেখেছি। তাই অন্তত নিজের অভিজ্ঞতাতে চুলের কাটের সঙ্গে চারিত্রিক পরিবর্তনের উদাহরণ পাইনি। তবে কি প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চুল কাটলে বখাটে ভালো হয়ে যাবে? তেমন হলে তো ভালোই! প্রশাসন, পুলিশ বা মা-বাবাকে আর কষ্ট করতে হবে না। ছেলে বিপথে গেলেই ধরে এনে ‘সঠিকভাবে’ চুল-দাড়ি কেটে দিলেই ল্যাটা চুকে গেল। কেল্লা ফতে!
ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি আমরা সবাই মুখে বলি, কিন্তু আদৌ তা ভালোভাবে বুঝি বলে মনে হয় না। একজন ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব বিষয়ে নিজে যে সিদ্ধান্ত নেবেন, চূড়ান্ত-সাদামাটা ভাষায় এটিই ব্যক্তিস্বাধীনতা। প্রশাসন যেটি করছে, তা হলো আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন যখন এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই নরসুন্দরেরা সেটি গুরুত্ব দিয়েই দেখবেন। ফলাফল, চুল-দাড়ি কাটা হচ্ছে ‘নির্দেশনা’ মতো। এরপর হয়তো পোশাক-আশাকেও নজর যাবে। বলা হবে, এমন পোশাক এভাবে পরা যাবে না, ওভাবে হাঁটা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যক্তিস্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়টি এ দেশে পুরোনো। সামাজিক ও পারিবারিকভাবেও এই নিয়ন্ত্রণ আছে। তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ কঠোর ও পীড়নমূলকও হয়। অনেককেই দেখেছি পরিবার চায় না বলে পছন্দকে গলা টিপে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিষয় নিয়ে পড়তে। উদাহরণ আরও অনেক আছে। পারিবারিকভাবেই যখন এমন নিয়ন্ত্রণমূলক মনোভাব কারও মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন পরবর্তী জীবনেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। আজকের কুঁড়িই তো আগামী দিন ফুল হয়ে ফোটে। ফলে, এই নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়টি মনে রয়েই যায়। আর যখন ক্ষমতা এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তার প্রভাব বৃহৎ পরিসরেও দেখা যাওয়া স্বাভাবিক।
অবশ্য এই জায়গায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের মিল আছে। চুল কাটা নিয়ে কিন্তু সিঙ্গাপুর আমাদের থেকে এগিয়ে। ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকা হিপি সংস্কৃতি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছিল। তা ঠেকাতেই সিঙ্গাপুরের সরকার চুল বড় রাখা নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯৭২ সালের দিকে চুল বড় রাখা ব্যক্তিদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার সংকুচিত করা হয়েছিল। জরিমানার বিধানও ছিল। সিঙ্গাপুরের সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে তখন বলা হয়েছিল, কারও কপাল ছুঁই ছুঁই চুল থাকতে পারবে না। ভুরু স্পর্শ করে—এমন দৈর্ঘ্যে চুল রাখা যাবে না, চুলে কান ঢাকা যাবে না। ১৯৭৪ সালের এক হিসাবে জানা যায়, ওই সময় চুল বড় রাখায় আট হাজারেরও বেশি সরকারি কর্মীকে নাকি সতর্ক করা হয়েছিল। এখন অবশ্য সিঙ্গাপুরে এমন কঠোর নিয়ম নেই। তবে কি উন্নত হতে চাইলে আমাদেরও সিঙ্গাপুর হতে হবে?
এই প্রশ্ন জাগল একটি আশঙ্কা থেকে। ইদানীং সবকিছুতেই সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এ দেশকে তুলনা করার প্রবণতা দেখা যায়। চলতি মাসেই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ডেঙ্গু মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এখন এ দেশে ডেঙ্গু এসেছে। অর্থাৎ, উন্নত দেশ হতে গেলে কিছু সুবিধা-অসুবিধা মেনে নিতেই হবে। ডেঙ্গুতে শতাধিক প্রাণহানির পরও যখন দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে এসব মন্তব্য শুনতে হয়, তাতে ভয় হয়, কখন না আবার চুল কাটা নিয়েও এমন কিছু শোনা যায়।
অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তর বলে দিয়েছে, চুল কে কীভাবে কাটবে, সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তারা কাউকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, চুল নিয়ে টানাটানির পেছনে আছে অতিমাত্রায় উৎসাহ, সন্ধি করলে অত্যুৎসাহ। উৎসাহ থাকা ভালো। জনগণের সেবা করতে হলে সরকারি কর্মচারীদের অবশ্যই উৎসাহী হতে হবে। তবে কোনো কিছুই মাত্রাছাড়া হওয়া ভালো নয়। তাতে অমঙ্গল হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এমন তো নয় যে দেশে আর কোনো সমস্যা নেই! চাঁদাবাজ আছে, উত্ত্যক্তকারী আছে, ধর্ষক আছে, প্রভাবশালীদের হুমকি-ধমকি আছে; এক কথায় সমস্যার শেষ নেই। সেগুলো আগে মিটুক। ওই সব ক্ষেত্রে কিন্তু সময়-সময় স্থানীয় প্রশাসনের ‘স্পিকটি নট’ থাকার অভিযোগ ওঠে। ওসব ঠিক না করে চুল নিয়ে চুলোচুলির কী দরকার? নাকি চুল দিয়েই দোষ ঢাকতে হবে?
চুল বরং নিজের জায়গাতেই থাক। এ ক্ষেত্রে অন্তত সিঙ্গাপুর হওয়ার তাড়া না থাকাই মঙ্গল।
অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
arnab.sanyal@prothomalo.com