‘নিজের চরকায় তেল দাও’—প্রাচীন এই প্রবচন প্রায়ই লোকের মুখে শোনা যায়। এর আসল অর্থ চরকায় তেল দাও, চরকা ভালো ঘুরবে, সুতা ভালো হবে। তবে এর নিগূঢ় অর্থ ভিন্ন। এটা যে শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে ঘটে, তেমনটা নয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এমনটা হয়ে থাকে। এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে জড়িয়ে পড়ে। আবার ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নিজেদের আধিপত্যের বলয় গড়ে তুলতে কারণে-অকারণে অন্য দেশের চরকায় তৈল মর্দন করে। আর যে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট যত বেশি হয়, সেই দেশে প্রভাব বিস্তার তত সহজ। এতে দুই পক্ষই সুবিধা লাভ করে। আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের তাদের করায়ত্ত কায়েম করার কাজটি সহজ হয়।
এত কথা আসলে বলা ভারত মহাসাগরের ছোট দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গ নিয়ে। এর আগেও আধিপত্যবাদীদের খপ্পরে পড়ে একই অঞ্চলের আরেকটি দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে। বিশেষজ্ঞর মতে, এই দুটি দেশ প্রতিবেশী দুই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্বের বলি, যা কারণে সে দেশের নাগরিকদের বারবার কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, হয়তো এখনো যেতে হচ্ছে। যদিও মালদ্বীপে গত সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীর অপ্রত্যাশিত জয়ে সেই রাজনৈতিক সংকট আপাতত কেটে গেছে। এরপরও দেশটির রাজনৈতিক ক্ষত এখনো রয়ে গেছে, যা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে বহুদিন।
তবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট এতটাই গভীরে চলে গেছে, তা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার আশা খুবই ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে। এই সংকট সমাধানে গত রোববার দেশটির প্রথম সারির নেতারা প্রথমবারের মতো বৈঠক করলেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। দেশটিতে রাজনৈতিক বিভাজন এতটাই যে পার্লামেন্টে ঢাল-তলোয়ার নেওয়ার অনুমতি থাকলে পার্লামেন্ট সদস্যরা হয়তো তা-ই করে বসতেন। পার্লামেন্টের ভেতর সদস্যদের দুটি পক্ষ একাধিকবার যেভাবে সংঘাতে জড়িয়েছেন, মরিচের গুঁড়া ছুড়েছেন, সেটা থেকে তেমনটাই ইঙ্গিত মেলে।
পার্লামেন্ট সদস্যদের মারমুখী এই অবস্থান ও বিভেদের রাজনীতি প্রকট হওয়ার সূত্রপাত প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার একটি নিয়োগকে কেন্দ্র করে। গত ২৬ অক্টোবরে আচমকা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করে প্রেসিডেন্ট ওই পদে তাঁরই একসময়কার ‘শত্রু’ মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে আসীন করেন। এই রদবদলের পেছনে সিরিসেনার যুক্তি, অর্থনৈতিক নীতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য। তাঁর যুক্তি, সাদা চোখে দেখলে একপ্রকার ঠিকই মনে হবে। তবে একটু গভীরে তাকালে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে হঠাৎ এই রদবদলের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে; সেটা হলো চীন ও ভারতের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। সেটার বলি হচ্ছে দেশ শ্রীলঙ্কা। আর শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারত-চীন কেন জড়াবে এবং শ্রীলঙ্কার রাজনীতিবিদেরা কেনইবা এই দুটি দেশের উসকানিতে প্ররোচিত হবে, তা জানা দরকার।
এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে সিরিসেনা যাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছেন, সেই রাজাপক্ষে আর যা-ই হোক স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ নন। ২০০৫-১৫ সাল পর্যন্ত দুই দফা প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সে সময়ে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী তথা স্বাধীনতাকামী তামিল বিদ্রোহীদের কড়া হাতে দমন করেন। ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি তামিল বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হলেও শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের কাছে ‘জাতীয় বীর’-এর সম্মান পান। রাজাপক্ষে যে তামিলদের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ চালান, তাদের বেশির ভাগ ভারত থেকে যাওয়া। তাই ভারত রাজাপক্ষের সেই অভিযানকে কখনো মেনে নেয়নি, আর কখনো নেবেও না। রাজাপক্ষে তাঁর কাজের সমর্থন পেতে ক্ষমতাধর চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একনাগাড়ে দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা রাজাপক্ষের প্রভাব তখন এতটাই ছিল যে তাঁকে আর কেউ গদিছাড়া করতে পারবে না—এমনটাই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতার মালিক জনগণ, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে। রাজাপক্ষে ধরাশায়ী হলেন তাঁরই একসময়কার সহযোগী সিরিসেনার নেতৃত্বাধীন জোটের কাছে। রাজাপক্ষের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান, তামিলদের বিরুদ্ধে অভিযানের তদন্তসহ একাধিক পরিবর্তনের ইশতেহার দিয়ে নির্বাচনে বাজিমাত করে ওই জোট। সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট ও রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হলেন জোটের দুটি প্রধান দলের প্রতিনিধি হিসেবে। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসায় শ্রীলঙ্কানরাও আশায় বুক বেঁধেছিল নতুন সূর্যের ভোর দেখার জন্য। চলছিলও ঠিকই। কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝিতে কোথায় যেন গোল বাঁধল। আর সেটার কারণেই রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্যে দিয়ে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের মূলে ভুরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ভারত ও চীন। ভারত মহাসাগরের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তারে তৎপর দেশটির ঐতিহ্যগতভাবে মিত্র ভারত ও উদীয়মান বিশ্ব অর্থনীতির দেশ চীন। পশ্চিমাপন্থী বিক্রমাসিংহে ভারতের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। আর সিরিসেনার চীনের বিনিয়োগের প্রতি ঝোঁক বেশি। বিক্রমাসিংহের প্রশাসন হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ চীনের গুরুত্ব কয়েকটি প্রকল্প স্থগিত করে। সিরিসেনা যেখানে চীনের বেশি বেশি বিনিয়োগের আশা করছেন, সেখান বিক্রমাসিংহের এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেননি সিরিসেনা ও তাঁর সমর্থকেরা।
ব্রাসেলসভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের (এসএডিএফ) গবেষক সিগফ্রাইড ও ওলফ সম্প্রতি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, শ্রীলঙ্কার সংকটকে শুধু সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের দ্বন্দ্বের ফল হিসেবে দেখা যাবে না। এটাকে এই অঞ্চলে চীন ও ভারতের দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবে দেখা উচিত। চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থে বিক্রমাসিংহের প্রশাসন ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জ জানানোয় এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সংকটের আরেকটি কারণ সিরিসেনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের গুঞ্জন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সিরিসেনাকে হত্যার ছক কষছে বলে কিছুদিন আগে ভারতের গণমাধ্যমে খবর বের হয়। ওই খবরে বলা হয়, সিরিসেনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁর হত্যার ষড়যন্ত্রে কথা তুলে ধরেন। যদিও পরে ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয়ই সিরিসেনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের খবরকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় ভারতের এক নাগরিক ও শ্রীলঙ্কার একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খবরটি যদি গুজবই হয়, তাহলে এই দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কোনো মানে হয় না।
এসবের কারণেই হয়তো সিরিসেনা ভারতকে পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন। এসবের মধ্যে বিক্রমাসিংহের ভারত সফরকেও ভালো চোখে নেননি সিরিসেনা। বরখাস্ত হওয়ার আগের সপ্তাহে বিক্রমাসিংহে ভারতে যান দেশটির অর্থনৈতিক সহায়তার আশায়। তাই বিক্রমাসিংহেকে বাদ দিয়ে চীনপন্থী রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন সিরিসেনা। যদিও সিরিসেনার এই নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ২০১৫ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের পরিবর্তে পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়। সিরিসেনার এই সিদ্ধান্তকে যে কয়েকটি দেশ স্বাগত জানিয়েছে তাদের মধ্যে চীনও রয়েছে।
বিশেজ্ঞরা মনে করেন, রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদে ফেরা মানে ভারতসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের কবর রচনা। এই অবস্থায় দুই দেশই নৌযোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রীলঙ্কায় নিজেদের আধিপত্য অটুট রাখতে চাইছে। ক্ষমতাধর এই দুই দেশের প্রস্তাব বিস্তারের দ্বন্দ্বে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ নেপালে। ক্ষমতাধর দেশগুলো নিজেদের আধিপত্যের বলয় এভাবেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। রাজনীতিবিদেরা ওই দেশগুলোর ছায়াতলে থেকে ক্ষমতা সুসংহত করতে বুঝে না বুঝে তাদের সুযোগ-সুবিধা দেন, গুণকীর্তন ও তৈল মর্দন করেন। সেই কারণে ভোটার হারায় তাঁর ভোটের অধিকার, ব্যাহত হয় গণতান্ত্রিক ধারা। ভেঙে পড়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি, আইনের শাসন। মানুষ হয় ক্ষমতার খেলার দাবার ঘুটি।
কামরুজ্জামান, সহসম্পাদক, প্রথম আলো