চীন-ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা কি থেমে গেছে

ভারত ও চীনের স্থল সীমান্তে চাপা একটি উত্তেজনা চলছে
ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এশিয়ায় চীনের আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদ, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান সীমান্ত সংঘাতের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তবে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ হিমবাহী উচ্চতায় বিশ্বের জনসংখ্যাধিক্যগত এই দুই মহারথী দুই বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আছে এবং তাদের মধ্যে হিংসাত্মক সংঘর্ষের আশঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এই সংঘাতের শুরু ২০২০ সালের মে মাসে। যখন শীতের তীব্রতা কেটে যাচ্ছিল এবং পর্বতের বরফ গলতে শুরু করায় সীমান্ত বাহিনীর চলাচলের পথগুলো পুনরায় চলার উপযোগী হচ্ছিল।

এ রকম একটি সময়ে ভারত এটি দেখে তাজ্জব হয়ে গেল যে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) গোপনে ঢুকে তার লাদাখ এলাকার কয়েক শ বর্গমাইল এলাকা দখল করে ফেলেছে। এটি বেশ কয়েকটি সামরিক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। এর ফলে চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো লড়াইয়ে চীনের সেনাদের প্রথম মৃত্যু ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হিমালয় অঞ্চলে নজিরবিহীন দ্রুততায় সেখানে দুই পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী সৈন্যদল গঠনের সূত্রপাত ঘটে।

ভারতের পাল্টা আক্রমণ শেষ পর্যন্ত পিএলএকে কিছু এলাকা থেকে হটিয়ে দেয় এবং একপর্যায়ে উভয় পক্ষ দুটি যুদ্ধক্ষেত্রকে বাফার জোনে রূপান্তর করতে সম্মত হয়। কিন্তু গত ১৫ মাসে অন্যান্য এলাকায় উত্তেজনা প্রশমিত করার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। দীর্ঘ বিতর্কিত সীমান্তে কয়েক হাজার চীনা ও ভারতীয় সেনা কার্যত সতর্কভাবে অবস্থান নেওয়ায় সেখানে একটি সামরিক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।

জবরদস্তিমূলক সালামি আদায়ের কৌশল ইতিমধ্যেই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে দক্ষিণ চীন সাগরের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিতে সক্ষম করেছে। ভারত, ভুটান ও নেপালের বিরুদ্ধে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করাকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ভারতের হাতে শক্তি প্রয়োগ করে পাল্টা প্রতিরোধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

তবে অচলাবস্থা মানেই স্থবিরতা নয়। চীন তার অনুকূলে হিমালয়ের পরিবেশ-প্রতিবেশকে দ্রুত তার নিজের মতো করে গভীরভাবে পরিবর্তন করে চলেছে। সেখানে তারা ইতিমধ্যে ৬২৪টি সামরিকীকৃত সীমান্ত গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কৃত্রিম সামরিক দ্বীপ তৈরির কৌশলেরই প্রতিফলন। সীমান্তে তারা এই গ্রামগুলোর কাছেই যুদ্ধের জন্য উপযোগী নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করছে।
এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে চীন সম্প্রতি প্যাংগং লেকের ওপর একটি সেতু বানানো শেষ করেছে (যেখানে দুই দেশের সেনাদের সংঘর্ষ হয়েছিল)। এই জায়গা ভারতের লাদাখ অঞ্চলের একটি বিতর্কিত এলাকায় চীনের অবস্থানকে শক্তিশালী করার সুযোগ করে দিয়েছে।

চীন ভুটানের ভূখণ্ডে বেআইনিভাবে সামরিক যান চলাচলের জন্য রাস্তা এবং নিরাপত্তা অবকাঠামোও তৈরি করেছে। ভুটানের সঙ্গে ভারতের উত্তর–পূর্ব অঞ্চলের সংযোগ স্থাপনকারী ‘চিকেন নেক’খ্যাত সরু করিডরকে উপেক্ষা করে ভারতের সীমান্তের একটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অংশে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ার জন্য চীন এসব নির্মাণ করেছে।
চীন আশা করছে, এসবের মাধ্যমে তারা ভারতকে বলতে পারবে: চীন তোমাদের যে অঞ্চল দখল করেছে, সেটি মেনে নাও, নইলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি নাও।

চীনের সম্প্রসারণবাদ প্রতারণা, ছলচাতুরী এবং সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি ছড়ানোর ওপর দৃশ্যত দাঁড়িয়ে আছে। চীন ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম আক্রমণ করার কৌশলগত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং প্রকাশ্য সশস্ত্র সংঘাতে হাইব্রিড যুদ্ধ চালাতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এটি চীনকে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর জমি দখলসহ তার কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলোকে এগিয়ে নিতে সক্ষম করে। জবরদস্তিমূলক দর-কষাকষি এবং প্রকাশ্য ভয়ভীতি প্রদর্শন প্রতিপক্ষের প্রতিরোধকে ঠেকাতে সহায়তা করে।

এই জবরদস্তিমূলক সালামি আদায়ের কৌশল ইতিমধ্যেই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে দক্ষিণ চীন সাগরের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিতে সক্ষম করেছে। ভারত, ভুটান ও নেপালের বিরুদ্ধে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করাকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ভারতের হাতে শক্তি প্রয়োগ করে পাল্টা প্রতিরোধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

এটি নিশ্চিত যে চীন ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করা এমনি এমনি বন্ধ করবে—এমনটি মনে করা ভারতের সামান্যই উপকার করবে। সর্বোপরি ভারতের এই পরিস্থিতিতে পড়ার কারণ হলো, তার রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সীমান্তের কাছে চীনের সামরিক তৎপরতার দিকে নজর দিতে ব্যর্থ হয়েছিল।

শুধু তা–ই নয়, চীন যখন ভূখণ্ড দখলের আয়োজন করছিল, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রেসিডেন্টের বন্ধুত্ব পেতে তাঁর পেছনে ছুটছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে চীনের সঙ্গে ভারতের প্রথম সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আগের পাঁচ বছরে মোদি তাঁর চীনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে ১৮ বার দেখা করেছিলেন। এমনকি একটি প্রত্যন্ত হিমালয় মালভূমিতে ২০১৭ সালের বিবাদের পরও মোদি তাঁর চীনকে তুষ্ট করার নীতি থেকে সরেননি।

একজন শক্তিধর নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য মোদি চীনের হাতে ভারতীয় ভূখণ্ড হারানোর কথা স্বীকার করেননি।

ইতিমধ্যে মোদি ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এত দ্রুত বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছেন যে এখন তা ভারতের মোট প্রতিরক্ষা বাজেটকেও (বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম) ছাড়িয়ে গেছে। তিনি সেই চীনকে এই সুবিধা দিচ্ছেন যে চীন ভারতের সঙ্গে আগ্রাসী আচরণ করে আসছে।
ভারত স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সামরিক প্রস্তুতির ‘সর্বোচ্চ স্তরে’ রয়েছে। এটি কোনো ফাঁকা বুলি নয়। এখন সীমান্তে ভারতের যে প্রস্তুতি রয়েছে, তাতে সি চিন পিং যদি যুদ্ধ চালিয়ে বর্তমান অচলাবস্থা ভাঙতে চান, তবে বড় ধরনের সংঘাত লেগে যাবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক