চীন-আমেরিকা দৌড়ে কে জিতবে

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

প্রযুক্তি জগতে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে আমেরিকা ও চীন। একুশ শতকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, সেই প্রযুক্তি খাত (জৈবপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি) উন্নয়নের সামনের সারিতে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে আমেরিকা। দেশটির গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বহুদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। চীনের সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটি প্রতিবছর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান বিবেচনায় একটি তালিকা করে। সেখানে মানের ভিত্তিতে বার্ষিক একাডেমিক র‍্যাঙ্কিং নির্ধারণ করা হয়। এ বছর ওই তালিকার শীর্ষে থাকা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টিই যুক্তরাষ্ট্রের। তালিকায় চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠাঁই পায়নি।

কিন্তু চীন তাতে মোটেও হতোদ্যম হয়নি। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে দেশটি সমানে অর্থ ঢেলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি বিকাশে তারা ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এআই খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে চীন এগোচ্ছে। শুধু এআই নয়, অন্য অনেক খাতেও চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। অনেকের মতে, চীন তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যথার্থভাবেই নিজেকে তৈরি করছে। দেশটি হাতের বিশাল উপাত্ত সম্পদ রয়েছে। যন্ত্রনির্ভর অর্থনীতির বিকাশের কারণে সামনের দিনগুলোতে বিজ্ঞানীদের চেয়ে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীর বেশি প্রয়োজন হবে। সেদিকটা মাথায় রেখে চীন এগিয়ে যাচ্ছে।

সাধারণ কারিগরি জ্ঞানের ওপর গুরুত্বারোপ করে চীন একদিকে যন্ত্র পরিচালনায় সক্ষম দক্ষ মানবশক্তি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সারা বিশ্বেই আলাদা তাৎপর্য নিয়ে বিশ্ববাজারে আসছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির সাইবার চুরি, জোরপূর্বক আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) স্থানান্তর এবং অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলনের জন্য চীনকে শাস্তি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, চীন যদি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গুগল ও ফেসবুককে তার বাজারে নিষিদ্ধ করতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও হুয়াওয়ে ও জেডটিইর মতো চীনা জায়ান্টদের বিরুদ্ধে এক পদক্ষেপ নেবে। সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হুয়াওয়ে ও জেডটিই নিষিদ্ধ আছে।

২০০৮ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার পর চীনের নেতারা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, আমেরিকার শক্তি পড়তির দিকে যাচ্ছে। চীনের আধুনিক কাঠামোর প্রাণপুরুষ দেং জিয়াওপিং শক্তি প্রদর্শনের বদলে গোপনে গোপনে সমৃদ্ধির ধাপ পার হওয়ার নীতি অনুসরণ করতেন। তাঁর নীতি থেকে চীন সরে এসে শক্তি প্রদর্শন শুরু করছে। দেশটি দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ (আসলে সামরিক স্থাপনা) গড়ে তুলছে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক জোরজবরদস্তি করছে এবং হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসছে। চীনের এই দম্ভপূর্ণ আচরণের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই বাইডেন প্রশাসনকে চীনের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলে থাকেন। কিন্তু বিশাল অঙ্কের খরচ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিকে চীন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে—এটি মনে করা ভুল হবে।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লা বিচার করলে দেখা যাবে, তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটা বড় ভূমিকা রাখবে বটে, কিন্তু তার চেয়ে বড় ভূমিকা থাকবে ওয়াশিংটন ও বেইজিং কে কতটা দল ভারী করতে পারবে, তার ওপর।

দুই দেশের পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ককে শীতল যুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের ধরন থেকে আলাদা করে রেখেছে। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক ছিল একমাত্রিক দাবা খেলার মতো, যেখানে দুই দেশের মধ্যে কোনো পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও আন্তদেশীয় সম্পর্কের বিষয় ছিল না। কিন্তু চীনের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ত্রিমাত্রিক দাবার বোর্ডে নেমে খেলতে হচ্ছে। এখানে সামরিক, অর্থনৈতিক ও আন্তদেশীয় পর্যায়ে বিশাল পরিসরের শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছে। যদি আমরা অর্থনৈতিক অথবা আন্তদেশীয় ক্ষমতাভিত্তিক সম্পর্ককে উপেক্ষা করি, তাহলে নিশ্চিতভাবে দাবার বোর্ডের উল্লম্ব মিথস্ক্রিয়া ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে এবং আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চীন মোকাবিলা করার নীতিতে শুধু সামরিক তৎপরতাকে বিবেচনায় রাখলে হবে না, এখানে পারস্পরিক নির্ভরতার তিনটি মাত্রাকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে যে বিধি ও নীতি, সেগুলো পুনরায় পর্যালোচনা করতে হবে। মহামারির আগে চীনের দ্রুত বর্ধনশীল রাষ্ট্রীয় পুঁজিব্যবস্থা এমন একটি বাণিজ্যবাদী মডেল অনুসরণ করেছিল, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যক্রমকে বিকৃত করেছিল এবং তা পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী জনমনোরঞ্জনবাদের উত্থানে ভূমিকা রেখেছিল।

আজ আমেরিকার মিত্ররা চীনের গুপ্তচরবৃত্তি, অন্য দেশের হাতে জোরপূর্বক চীনা প্রযুক্তি গছিয়ে দেওয়া, চীনের কৌশলগত বাণিজ্যিক লেনদেন এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তিসংক্রান্ত নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকির বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। এর ফল হিসেবে যা দাঁড়াবে তা হলো, চীনের সঙ্গে তাদের প্রযুক্তি সরবরাহ শৃঙ্খল বা সাপ্লাই চেইন আরও বেশি ছিন্ন হতে থাকবে, বিশেষ করে যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেখানে এই শৃঙ্খল ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে আলোচনার ভিত্তিতে নতুন বাণিজ্য নিয়ম নির্ধারণ করা গেলে সেই ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লা বিচার করলে দেখা যাবে, তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটা বড় ভূমিকা রাখবে বটে, কিন্তু তার চেয়ে বড় ভূমিকা থাকবে ওয়াশিংটন ও বেইজিং কে কতটা দল ভারী করতে পারবে, তার ওপর।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডু মোরালস ম্যাটার বইয়ের লেখক