মতামত

চীনের সঙ্গে সংলাপে বসা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ

যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগই এখন আর চীনের উত্থানকে বাধা দিতে পারবে না
  ছবি: রয়টার্স

গত ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তাঁর দেশের চীননীতি নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে একরকম বিলাপই করেছেন। তাঁর অভিযোগ, বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে সাজানোর অভিপ্রায় রয়েছে চীনের। এ জন্য অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত—সব উপায়ই বেছে নিয়েছে তারা।

বিশ্বব্যবস্থা বদলে ফেলতে চীনের অভিপ্রায় রয়েছে কি না, জানা নেই। তবে এটা সত্যি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা যে নিয়মবিধি তৈরি করেছে, এশিয়ার শক্তি চীনের সেটা মেনে নেওয়ার ইচ্ছা নেই। কারণ, এ নিয়মবিধি সাধারণভাবে পশ্চিমাদের স্বার্থে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই তৈরি করা হয়েছে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে প্রণয়ন করা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিমালার কথা বলা যায়। গ্যাট (শুল্ক ও বাণিজ্য–সম্পর্কিত সাধারণ চুক্তি), এনটিবিএস (অশুল্ক-বাণিজ্যবাধা) গঠনের সময় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমদানির ওপর বিধিনিষেধের শর্ত যুক্ত করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পগুলো বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়লে দেশটির সরকার এনটিবিএস-কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের হুয়াওয়ে ও জেডটিই কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। মিত্রদেশগুলোকেও তিনি একই কাজ করতে চাপ দেন।

এ কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিপণ্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করেছিল, এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। চীন সরকার সেগুলো ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও দেশটির ব্যবসাসংক্রান্ত তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে—এ ধরনের কল্পনায় এ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

আবার বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে সাজানোর যে অভিযোগ চীনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, সেই একই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কেউ তুলতে পারে। অর্থসহায়তা কিংবা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শ ও মূল্যবোধ মেনে চলার শর্ত দেওয়া হচ্ছে। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করছে না, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে এ জবরদস্তি পরিষ্কারভাবে বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে সাজানোর একটি চিত্র।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন যে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ (আবার আগের সেই ভালো বিশ্বব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া) এবং ‘গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র’-এর স্লোগান তুলেছেন। এগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে বিশ্বব্যবস্থাকে সাজানোর কৌশল। পূর্বসূরি ট্রাম্পের সঙ্গে বাইডেনের পার্থক্যের জায়গাটা হচ্ছে—ট্রাম্প সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে সমমনা দেশগুলোকে লড়াইয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাতারে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাইডেন সেটা সরাসরি করছেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগই এখন আর চীনের উত্থানকে বাধা দিতে পারবে না। চীনের সঙ্গে পার্থক্যগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এর বিকল্প কিছু নেই।

যাহোক ইতিহাস এবং চীনের শক্তির যে গতিপথ তাতে বলা যায়, চীনকে ঠেকানোর এ প্রচেষ্টা সফল হবে না। চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের উল্টো ফল ফলেছে। এতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতির ব্যবধান কমেনি কিংবা শিল্প উৎপাদনও বাড়েনি। বরং মুদ্রাস্ফীতির বৃত্তে ঢুকে পড়েছে দেশটি। অন্যদিকে চীনের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তি ও সামরিক খাতে সক্ষমতা বেড়েই চলেছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা চীনের অর্থনীতিতে হতাশার চিত্র দেখেছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ।

করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি সহজ করেছে। ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে করের বোঝা কমানো হয়েছে। শুধু অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙা করা নয়, চীনের সরকার বিদেশে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডস’ উদ্যোগটি সম্প্রসারণ করেছে। বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় এ উদ্যোগের সঙ্গে এখন প্রায় ১০০টি দেশ যুক্ত হয়েছে। ২০১৩-২১ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে সহযোগী দেশগুলোর বাণিজ্য ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। একই সময়ে বিআরআই জোটভুক্ত দেশগুলোতে চীন ৯০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সুতরাং কেন একটি দেশ চীন যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তা বিসর্জন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হবে?

চীনকে ‘অর্থনৈতিক প্রতারক’ তকমা দেওয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। চীনকে ‘শয়তান’ হিসেবে চিত্রিত করার প্রবণতাটি এরই মধ্যে বিরক্তি ও বিদ্রূপের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, সলোমন দ্বীপের মতো দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের চরকায় নিজে তেল দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ন্যাটোর আদলে কোয়াড গড়ে তুলেছে। ১২টি দেশ নিয়ে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক রূপরেখা (আইপিইএফ) জোটেরও ঘোষণা দিয়েছে। এ দুটি উদ্যোগই চীনকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে এশিয়ার দেশগুলো চীনকে বিনিয়োগ ও ব্যবসার অংশীদার হিসেবে পেয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। কোনো এক পক্ষ নিতে তারা চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগই এখন আর চীনের উত্থানকে বাধা দিতে পারবে না। চীনের সঙ্গে পার্থক্যগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এর বিকল্প কিছু নেই।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

কেন মক লেখক এবং অর্থনৈতিক তত্ত্ব, জননীতি ও বিশ্বায়ন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান