জনস্বাস্থ্য

চাল উৎপাদনে চতুর্থ, কিন্তু পুষ্টিতে?

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

একসময় আমাদের বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হতো। আমরা চলতি ভাষায় বলতাম, আর কিছু চাই না, দুবেলা দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা হলে আর চিন্তা নেই। এখন আমরা চাল রপ্তানি করি। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে। খাদ্যনিরাপত্তা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন আমরা খাদ্যের সঙ্গে পুষ্টির কথাও জোর দিয়ে বলছি। গত সপ্তাহ ছিল পুষ্টি সপ্তাহ। এর একটি স্লোগান ছিল, ‘খাদ্যের কথা ভাবলে পুষ্টির কথাও ভাবুন’। এ কথার বিশেষ তাৎপর্য আছে।

পুষ্টির বিষয়ে সেদিন প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় বলা হয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তা, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, গড় আয়ু বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, কিন্তু পুষ্টির ক্ষেত্রে আরও অনেক দূর যেতে হবে। সেভ দ্য চিলড্রেন পুষ্টি নিয়ে কাজ করছে। সূচনা প্রকল্প সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় কাজ করছে। তাদের সঙ্গে আছে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ আরও ২২টি মন্ত্রণালয়। সহযোগিতা দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউকে এআইডি ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। লক্ষ্য হলো মানুষের, বিশেষভাবে গরিবদের পুষ্টির অভাব দ্রুত কমিয়ে আনা।

পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের অনেকেই সচেতন নন। সিলেট, মৌলভীবাজারসহ কয়েকটি জেলায় দেখা গেছে, মানুষের গড় উচ্চতা কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশুর পুষ্টির অভাব এর একটি মূল কারণ। শুধু নবজাতক পর্যায়েই না, এরপর শিশুর খাদ্যতালিকায় যথেষ্ট পুষ্টি উপাদান না থাকায় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ খর্বকায়। এটা শুধু সিলেট নয়, সেখানে প্রকল্পের কাজের মধ্য থেকে তথ্যটি এসেছে যে আসলে সারা বাংলাদেশেই মানুষের গড় উচ্চতা কম। এক হিসাব অনুযায়ী, দেশের এক-তৃতীয়াংশ শিশু এখনো খর্বকায়।

তবে সুসংবাদ হলো, গত কয়েক বছরে পুষ্টির ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়টি কাজের তালিকায় প্রথম সারিতে রাখায় এখন দেশের মানুষের গড় উচ্চতা বাড়তে শুরু করেছে। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে খর্বকায় সমস্যা ১০ শতাংশ কমেছে। জিডিপি ১০ শতাংশ বাড়লে খর্বকায় সমস্যা ৬ শতাংশ কমানো যায়। আমাদের আয় বাড়ছে। ফলে খর্বকায় সমস্যাও কমছে। সেই সঙ্গে জন্মকালে ওজনও বাড়ছে। সরকার শিশুদের খাদ্য-পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য সাড়ে ৯ লাখ মাকে মাসিক ভাতা দিচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৭৫ লাখ মাকে দেওয়া হবে। এরা মূলত নিম্ন আয়ের পরিবার। মায়ের হাতে আর্থিক ভাতা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো টাকাটা যেন সত্যি সত্যি শিশুর জন্য খরচ করা হয়।

আমরা অনেকে ভাবি, গড় উচ্চতা মা–বাবার জিনগত বৈশিষ্ট্য। তাই করার কিছু নেই। এটা হয়তো ঠিক। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিছু বৈশিষ্ট্য সন্তানেরাও পায়। কিন্তু এখন তো আমরা জানি, মাতৃপুষ্টি নিশ্চিত করলে, শিশু অবস্থা থেকেই যদি ভিটামিন এ, ডি, আয়রন, ক্যালসিয়ামসহ পুষ্টিকর উপাদান পাওয়া নিশ্চিত করা হয়, তাহলে খর্বাকৃতি সমস্যা থাকবে না। এখন চীন-জাপান-থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের মানুষ আর খর্বাকৃতির নয়। তাদের উচ্চতা বাড়ছে। আমাদের দেশেও এই প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটছে। এখনই গ্রাম থেকে শহর, সবখানে বেশ উচ্চতাসম্পন্ন ছেলেমেয়ে দেখি। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের দেশের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে।

পুষ্টি নিশ্চিত করার কাজটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠান বা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় একা করতে পারবে না। সরকার ২২টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে পুষ্টি নিশ্চিত করার কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাজের সমন্বয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

তবে শুধু ওপরের দিকে সমন্বয় যথেষ্ট নয়। একেবারে মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যেও সমন্বয় দরকার। আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যদি আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-২ অভীষ্ট অর্জন করতে চাই, তাহলে এটা দরকার। সরকার বলছে, তাদের কাজের ফলে নির্ধারিত ২০৩০ সালের আগেই সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্ধারিত মাত্রায় পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের মানুষ যে পুষ্টির গুরুত্ব একেবারে জানত না, তা নয়। প্রবাদ আছে, ‘দুধে-ভাতে বাঙালি’। আমরা বলি ‘মাছে-ভাতে সুখে থাকি’। ‘দুমুঠো ডাল-ভাত’। আর শাকসবজি তো আছেই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই কথাগুলো বলতেন এই কারণে যে দুধে রয়েছে যথেষ্ট প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। মলা-ঢ্যালা মাছে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। ডালে আছে যথেষ্ট প্রোটিন। আর সেই আমলে তো ভেজাল বলতে তেমন কিছু ছিল না। তাই সেই প্রাচীনকালের প্রবাদবাক্যগুলো মানলে আমাদের আজ আর খর্বকায় থাকতে হতো না। কিন্তু গুরুত্ব দিইনি। শুধু পেট ভরে ডাল-ভাতই যথেষ্ট মনে করতাম। শক্তির উৎস হিসেবে ভাতের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার সঙ্গে পুষ্টিকে তালিকায় অপরিহার্য উপাদান হিসেবে রাখার তাৎপর্য না বুঝলে তো সুফল পাওয়া যাবে না।

সরকার এখন ‘স্কুল ফিডিং’ কর্মসূচি নিয়েছে। ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছে সরকার। স্কুলে, বিশেষভাবে প্রাইমারি স্কুলে, গ্রাম ও শহরের বস্তি এলাকায় যদি শিশুদের দুপুরে এক কাপ দুধ, একটা কলা, একটা ডিম খাওয়ানো যায়, তাহলে সরকারের আরেকটি সাফল্যগাথা নির্মিত হবে। এই কর্মসূচি সফল করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এখানেও মনে রাখতে হবে, সবকিছু সরকার করে দেবে, এটা ভাবলে ভুল হবে। স্থানীয় জনসাধারণ, সামাজিক সংগঠন, এনজিও, জাতিসংঘভুক্ত সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএসএআইডি প্রভৃতি এবং সেই সঙ্গে সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রম ছাড়া এই উদ্যোগ সফল করা কঠিন। সরকারও সেটা চায়।

মা ও শিশুর প্রতি একটু মনোযোগ দিলে মানুষের উচ্চতা প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব। এখানে সফল না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail.com