নিরপরাধ ১৪ জন ইরাকিকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা চারজন মার্কিন ভাড়াটে খুনিকে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতা ছাড়ার কয়েক সপ্তাহ আগে নির্বাহী ক্ষমতাবলে ক্ষমা করে দিয়েছেন, সেই একই প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রশাসনকে কেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেডারেল কয়েদিদের মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন, সে এক রহস্যময় প্রশ্ন।
কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে গত এক বছরে ১০ জনকে হত্যা করেছে। আমেরিকার সব অঙ্গরাজ্য এক বছরে এত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগামী মাসে ক্ষমতা ছাড়ার আগে আরও তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে একজন খুনের আসামি আছেন, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সময় যাঁর বয়স ছিল আঠারো বছর। এ ছাড়া একজন নারী কয়েদিও আছেন। গত ৭০ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রথম কোনো নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ঝুলে থাকা মৃত্যুদণ্ডগুলো কেন তাড়াহুড়ো করে কার্যকর করছে? এটি কি নির্বাচনে হেরে যাওয়া ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ, নাকি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তাঁর চেয়ে কম মনের জোরওয়ালা প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনগণের সামনে প্রমাণ করার চেষ্টা?
ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া যাবতীয় বিধিবিধান টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার সেই যুবকের মতো ট্রাম্পও তাঁর চেয়ে গুণে–মানে এগিয়ে থাকা সব নেতার সব আদর্শ টেনে নিজের স্তরে নামিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছেন
এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেলজিয়ামের বংশোদ্ভূত চীনতত্ত্ববিদ সাইমন লেইসের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি একবার ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্সকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। মাদার তেরেসাকে নিয়ে হিচেন্স দ্য মিশনারি পজিশন শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে মাদার তেরেসার কঠোর সমালোচনা ছিল।
লেইস মনেপ্রাণে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। লেইসের বিশ্বাস, মাদার তেরেসার বিষয়ে হিচেন্সের বিদ্বেষমূলক মনোভাব ছিল এবং হিচেন্স সে কারণে মাদার তেরেসার সমালোচনা করে তাঁকে তাঁর (হেচেন্সের) স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।
একদিন লেইস অস্ট্রেলিয়ার কোনো একটি এলাকায় খদ্দরে গিজগিজ করা একটি ক্যাফেতে কাজ করছিলেন। রেডিওতে ফালতু ধরনের পপ মিউজিক বাজছিল। তাঁর এই আওয়াজ ভালো লাগছিল না। হঠাৎ রেডিওর সেই পপ গান থেমে গেল এবং মোৎসার্টের মিউজিক বাজতে শুরু করল। মুহূর্তে সবাই চুপ হয়ে গেলেন। ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল। কয়েক মুহূর্ত পরে আচমকা এক যুবক উঠে দাঁড়ালেন এবং মহা বিরক্তি প্রকাশ করে রেডিওর চ্যানেল ঘুরিয়ে আবার একই ধরনের পপ মিউজিক বাজানো শুরু করলেন।
লেইস পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন। ওই যুবক কি ধ্রুপদি সংগীত ঘৃণা করেন? তাঁর কি বিশেষ করে মোৎসার্টের মিউজিকের বিষয়ে অ্যালার্জি আছে? অথবা এমনও কি হতে পারে, ওই যুবক এমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন যে শুদ্ধ সংগীত বোঝার মতো জ্ঞান বা রুচি তাঁর গড়ে ওঠেনি?
লেইস উপসংহার টেনে বলেছেন, তাঁর মনে হয়েছে, ওই যুবক মোৎসার্টের মিউজিকের ওজন এবং মান সম্পর্কে ভালোভাবেই ধারণা রাখেন এবং সে ধারণাই তাঁকে সেটি বন্ধ করতে উসকানি দিয়েছে।
লেইসের মনে হয়েছে, মোৎসার্টের সুর ওই যুবককে মনে করিয়ে দিচ্ছিল তিনি মোৎসার্টের তুলনায় কত ক্ষুদ্র, কত গুরুত্বহীন ও রুচিবিবর্জিত। এ কারণে তিনি মোৎসার্টের সেই সংগীতকে বন্ধ করে দিয়ে মোৎসার্টকে নিজের স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর গত চার বছরের ক্ষমতাকালে ঠিক একই কাজ করে গেছেন। একের পর এক তিনি এমন সব কাজ করেছেন, যা দেখলে মনে হবে তিনি তাঁর চেয়েও সভ্যভব্য ও উন্নত চরিত্রের মানুষদের ছোট করার মিশনে নেমেছেন এবং তাঁদের তাঁর (ট্রাম্পের) নিজের স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার ত্রুটি ছিল, কিন্তু তিনি সব সময়ই মর্যাদাবোধ ও পরিমার্জনের বাতাসকে বইতে দিয়েছেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামা অতি অমায়িক ভদ্র দম্পতিদের মডেল হয়ে আছেন।
আর গত চার বছরে আমরা দেখলাম, ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া যাবতীয় বিধিবিধান টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার সেই যুবকের মতো ট্রাম্পও তাঁর চেয়ে গুণে–মানে এগিয়ে থাকা সব নেতার সব আদর্শ টেনে নিজের স্তরে নামিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ইয়ান বুরুমা নেদারল্যান্ডসের বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক