রাজনীতি

চারদিকে ভাঙনের শব্দ শুনি

কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন,
দালান উঠেছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার, তাও রাজনীতি
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!

কিন্তু অধুনা রাজনীতিতে শুধু ভাঙনের শব্দ শুনছি। কোথাও কিছু গড়ে উঠছে না। শুধু রাজনীতিই–বা বলি কেন, আমাদের সমাজে, সংসারে ভাঙনের সর্বব্যাপী আয়োজন। ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষের নিরাপত্তা নেই। আস্থা রাখার মতো মানুষ নেই। দল নেই।

আগে আমাদের দারিদ্র্য ছিল, অভাব ও ক্ষুধা ছিল। তারপরও আমরা হতাশ হইনি। বুকে আশা জাগিয়ে রেখেছি এই ভেবে যে, ‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে।’ একদিন সুদিন আসবে। সেই সুদিনের জন্য আমরা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। এরপর তরুণেরা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারকে হটিয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্র আসেনি। এখন গণতন্ত্রী ও স্বৈরাচার একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা আর্থিক দারিদ্র্য অনেকটা জয় করেছি। প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছি। মানুষের গড় আয় ও আয়ু বেড়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বেড়েছে বৈষম্য। মানুষের মনের দারিদ্র্য যে কী ভয়ংকর রূপে চেপে বসেছে, তা প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই টের পাওয়া যায়। অনেক সময় মন্ত্রীরা উষ্মা প্রকাশ করেন, পত্রিকায় কেন আমরা শুধু শুধু নেতিবাচক খবর ছাপি। কেন হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতনের খবরে পাতা ভরে রাখি। তাঁদের সবিনয়ে বলব, না, পত্রিকায় সব নেতিবাচক খবর ছাপা হয় না। যা ছাপা হয়, তা অপরাধ-অনাচারের সামান্য অংশ মাত্র। কত মানুষের কত কান্না, কত দীর্ঘশ্বাস লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। এই সমাজে নুসরাত-শাহিনুর তনু-মিতুর মতো অসংখ্য নারী নিয়ত হিংসার বলি হচ্ছেন। রাষ্ট্র তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।

আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিপতিরা প্রায়ই জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখান, উন্নয়নের রথ কত জোরে সামনে এগোচ্ছে, তার নাতিদীর্ঘ বয়ান দেন। কিন্তু আধুনিক মানুষ তো শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তি করে বাঁচে না। তারা বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন দেখে, কথা বলার অধিকার চায়। মানবিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। ভোটাধিকারটুকু প্রয়োগ করতে চায়। অথচ সেসব চাওয়া ছলনা হয়েই থাকে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশের গ্লানি ধুয়েমুছে যাচ্ছে, আমরা কেন তাহলে মানবাধিকারের সূচকে, আইনের শাসনের সূচকে, সংবাদমাধ্যমের সূচকে সমানতালে এগোতে পারছি না। কেন আমরা গণতন্ত্রের সূচকে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি?

আগে সরকার দেশের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারলে মানুষ বিরোধী দলের ওপর ভরসা রাখত। বিরোধী দলও জনগণের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করত। তারা চেষ্টা করত জনগণের সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসতে। এখন জনগণকে নিয়ে কেউ ভাবে না। সরকারি দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা উন্নয়নের ফিরিস্তি শোনান। আর বিরোধী দলের নেতারা ‘সরকার রাস্তায় নামতে দিচ্ছে না’, এই অজুহাতে সবকিছু পাশ কাটিয়ে যান।

সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক দলগুলোতে যে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, তার কারণও হতাশা ও আদর্শহীনতা। আওয়ামী লীগ বড় দল বলে সাংগঠনিক ভিতও শক্ত। তাই ধাক্কাকে সহজে টের পাওয়া যায় না। তবে সরকার ও আওয়ামী লীগকেও এক করে দেখলে হবে না। সরকারের দায়িত্ব এক রকম। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব আরেক রকম। কিন্তু সরকারি দলের নেতারা এই ফারাকটা করতে পারেন না। আর পারেন না বলেই দল যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন সবকিছু ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়। অন্যদিকে ডান–বাম সব ছোট দলের লক্ষ্মণরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে পদ-পদবি, সুবিধা ছাড়া কোনো রাজনীতি নেই। এ কারণে আমরা দল দেখি, বড় বড় নেতা দেখি। কিন্তু রাজনীতি দেখি না। কোনো দলেই সুস্থ রাজনীতিচর্চার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

যেকোনো রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে। অথচ আমাদের এখানে পরস্পরবিরোধী আদর্শের দলগুলোর মধ্যে গভীর আঁতাত হতে দেখি। সেটি হলো স্বার্থের আঁতাত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এর মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে। যাঁরা আশির দশকে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিলেন, তাঁরাই এখন এরশাদের সহযোগী কিংবা সহমর্মী। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির নষ্ট প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। এরশাদ সাহেব একেক দিন একেক সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর সর্বশেষ হলো এক দিনে আট নেতাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা। এরশাদের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে সাংসদ ও দলের যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত আলী পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টিতে এখন যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা দলকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। এখন যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না।’

এর আগে এরশাদ একবার তাঁর ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে রওশনকে সেই পদে বসান। তারও আগে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে আবার সেই পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সর্বশেষ আবার তাঁকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন। গোলাম মোহাম্মদ কাদের সৎ ও যোগ্য নেতা। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কাজটি করা হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক নয়। জাতীয় পার্টির নেতারা বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারম্যান যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো পদে বসাতে পারেন। বিএনপির গঠনতন্ত্রেও চেয়ারম্যানকে একই রকম ক্ষমতা দেওয়া আছে। দলের প্রধানই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাহলে অন্যদের কী প্রয়োজন?

বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাম, জামায়াত—এবারে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। সব দলেই ওলটপালট অবস্থা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় নির্বাচন আর রাজনীতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে না। এর বড় প্রমাণ জেলা-উপজেলায় সরকারি দলের কর্তৃত্ব সীমিত হয়ে আসছে। প্রশাসনই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। জোট রাজনীতি নিয়ে বড় সংকটে আছে বিএনপি। নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্বে দুটি জোট হয়েছিল। ২০-দলীয় জোট আগে থেকেই ছিল। নতুন করে গঠিত হলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এখন দুই জোটেই ভাঙনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দু-একটি শরিক দল জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে। কোনো কোনো শরিক নেতা আবার শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেছেন, যথাযথ সম্মান না দিলে এক মাসের মধ্যে জোট ত্যাগ করব। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম রূপকার গণফোরামেও ত্রিমুখী ধারা। দলের সিংহভাগ ড. কামাল হোসেনের প্রতি আস্থাশীল থাকলেও ও ক্ষুদ্র একটি অংশ আলাদা দল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির জোটের শরিকদের প্রধান আপত্তি তাদের না জানিয়ে বিএনপির পাঁচজন সাংসদ শপথ নিয়েছেন। বিএনপির হাতে আরও একটি সাংসদ পদ আছে। নারী আসনে। কে মনোনয়ন পাবেন, তা নিয়েও নানা রকম গুঞ্জন চলছে। যাঁরা হরদম এই সংসদকে তুলোধোনা করেন, তাঁরাও পদটি পাওয়ার জন্য তদবির চালাচ্ছেন। আদর্শহীন রাজনীতির এটাই পরিণতি।

সরকারি দল আওয়ামী লীগে দৃশ্যত কোনো সমস্যা না থাকলেও নির্বাচনী শরিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। ১৪-দলীয় জোট টিকে আছে বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনে। নির্বাচনের আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিবেকের ভূমিকায় নেমেছিলেন। নানা হিসাব-নিকাশের পর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ব্র্যাকেটবন্দী হলেন। এখন আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অথচ ২০০২ সালে যখন বিএনপি তাঁকে গলাধাক্কা দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বের করে দিল, তখন তিনি দেশবাসীর সহমর্মিতা পেয়েছিলেন। আমাদের দেশে নন্দিত নেতার নিন্দিত হতে সময় লাগে না।

একজন মন্ত্রী বললেন, বিএনপি গণতন্ত্রের শত্রু। তাঁর কথা সত্য হলে এখন গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়ার কথা। কেননা, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল, ন্যুব্জ। গণতন্ত্রের শত্রু দুর্বল হলে তো গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়ার কথা। কিন্তু কোথাও তো তার আলামত দেখছি না। আবুল হাসানের কবিতার পঙ্ক্তি ধার করে বলতে হয়, দল ভাঙছে, তাও রাজনীতি, জোট ভাঙছে, তাও রাজনীতি। তবে সেটি সুস্থ রাজনীতি নয়। অপরাজনীতি। নষ্ট রাজনীতি।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com