ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙেছে। হাওরে ঢুকছে পাহাড়ি ঢলের পানি। তলিয়ে যাচ্ছে বোরো ধান। আধা পাকা সেই ধানই কাটতে ব্যস্ত কৃষক
ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙেছে। হাওরে ঢুকছে পাহাড়ি ঢলের পানি। তলিয়ে যাচ্ছে বোরো ধান। আধা পাকা সেই ধানই কাটতে ব্যস্ত কৃষক

মতামত

‘চান্সে মেরে দেওয়া’র অপেক্ষা, দুয়োরানি কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জরুরি প্রশ্ন

গুগল করে জানা যাচ্ছে, ঢাকা থেকে আকাশপথে কিয়েভের দূরত্ব ৫ হাজার ৮৮৭ কিলোমিটার। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হয়েছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। এই তিন মাস বাংলাদেশে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধে কে জিতবে, কে হারবে কিংবা এ যুদ্ধে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ইউরোপের মধ্যে কে লাভবান হবে, কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এই তিন মাসে প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে যুদ্ধটা বাংলাদেশেও ঢুকে পড়েছে। করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে পাগলা ঘোড়ার গতিতে বাড়ছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় কীভাবে নির্বাহ হবে, সেটাই এখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আলোচনার বিষয়।

পূর্ব ইউরোপে দুই প্রতিবেশীর সরাসরি যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গম, ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি, গুঁড়া দুধ, বিদেশি ফলসহ সব ধরনের আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এমনিতেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এ সুযোগে তাঁরা দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। সবাই যেন দাম বাড়ানোর উৎসবে মেতেছেন। বোরোর ভরা মৌসুমে তাই কোনো যুক্তি ছাড়াই চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার দেশে গমের সংকট দেখা দেওয়ার আগেই আটা, ময়দাসহ বেকারি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুযোগের সদ্ব্যবহারের এমন মওকা (জনসমাজে এখন এ প্রবাদ চালু ভিন্নভাবে, ‘চান্সে মেরে দেওয়া’) কে ছাড়ে ভুবনে!

মূল্যস্ফীতির কারণে একধাপে প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা কয়েক কোটি মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারি উদ্যোগ কী নেওয়া হচ্ছে, সেটা জনগণকে জানাতে হবে। ‘সংকট নেই, দেশের কোথাও হাহাকার নেই, অভাব নেই, হতাশা নেই’ কিংবা ‘মানুষ মনের সুখে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফিরছে’—মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষের ‘কাঁচা ক্ষতে নুনের ছিটা’ দেয়।

সব নিত্যপণ্যের দাম একযোগে বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ের সমন্বয় কীভাবে হবে, তা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বেশির ভাগ মানুষই বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে সংসার চালাবেন তাঁরা। ২১ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, চাল, ডাল, তেল ও আটায় ব্যয় বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। এর প্রভাব কিন্তু বাজারে পড়তে শুরু করেছে। ২১ মে প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, মাছের বাজারে ক্রেতা কমে গেছে। অর্থনীতির ভাষায় যেটাকে মূল্যস্ফীতি বলে, সেটাই গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য জীবিকার সংকট। আয় বাড়েনি এক টাকাও, কিন্তু জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রেই খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে খাবার খরচ, ওষুধের খরচ, ছেলেমেয়ে পড়াশোনার খরচ কসরত করে কেটেছেঁটেই জীবন চালাতে হচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, সংকটের এটা কেবল শুরু, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিপর্যয় হবে সর্বপ্রসারী।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তাতে ঘুরেফিরে বিশ্বমন্দা আসে। বলা হয়, ৩০ বছর পরপর বিশ্ব একেকটা মন্দার মুখে পড়ে। আবার যুদ্ধ, মহামারির মতো ঘটনাতেও অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দা ডেকে আনে। করোনা মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধ আরেকটা বিশ্বমন্দাকে অনিবার্য করে তুলেছে। এর আগে ২০০৭-০৮ সালে সর্বশেষ বিশ্বজুড়ে মন্দা দেখা দিয়েছিল। সেই মন্দায় বাংলাদেশেও খাদ্যদ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সে সময় করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়, জানুয়ারি ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ বেড়ে গিয়েছিল। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুষ্টিহীনতায় ভুগতে হয়েছিল, এমন মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি, সেটাকে এক অর্থে ‘যুদ্ধ’ই বলা যাবে। সেটা খাদ্য ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতের যুদ্ধ’। সত্যি বলতে, এক ছটাক ধানের উৎপাদন এখন ব্যাহত হওয়া মানেই পরাজয়ের বৃত্তে ঢুকে পড়া। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর সব দায় চাপিয়ে দিতে শুরু করেছেন। তাতে তাঁদের ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ‘চান্সে মেরে দিয়ে’ জনগণের টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়ার সুযোগ আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশে আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি, সেটাকে এক অর্থে ‘যুদ্ধ’ই বলা যাবে। সেটা খাদ্য ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতের যুদ্ধ’। সত্যি বলতে, এক ছটাক ধানের উৎপাদন এখন ব্যাহত হওয়া মানেই পরাজয়ের বৃত্তে ঢুকে পড়া। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর সব দায় চাপিয়ে দিতে শুরু করেছেন। তাতে তাঁদের ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ‘চান্সে মেরে দিয়ে’ জনগণের টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়ার সুযোগ আরও বিস্তৃত হচ্ছে। আপাতত বিশ্বে যাতে দ্রুত শান্তি ফিরে আসে, সেই ‘প্রার্থনা’ ছাড়া যুদ্ধ বন্ধে আমাদের করণীয় কিছু নেই। কিন্তু নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিজেদের নিশ্চিত করার যুদ্ধটি আছে। কিন্তু সেই বোঝাপড়া ও সাধারণ মানুষের জন্য দরদ নেতাদের আর কোথায়?

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরেক মূর্তিমান আতঙ্ক হচ্ছে মে মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা। এতে অনেক এলাকায় আধপাকা ধান তলিয়ে গেছে

হাওরে বোরো উৎপাদনে যাতে বিপর্যয় না আসে, তার জন্য গণমাধ্যম আগে থেকেই সতর্ক করে এসেছিল। কিন্তু সময়মতো বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে বড়সড় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে, ক্ষমতার সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নিজেদের স্বার্থে তারা হাওরের ধানের ওপর বাজি ধরতেও দ্বিধা করেনি। একেবারে শেষ মুহূর্তে বাঁধ হয়েছে। কাঁচা মাটির বাঁধ, তাতে পানি আটকানো যায়নি। এ কারণে হাওরে এবারও ধান নষ্ট হয়েছে; সরকারি হিসাবে যদিও সেটাকে সামান্য নষ্ট বলে বলা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরেক মূর্তিমান আতঙ্ক হচ্ছে মে মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা। এতে অনেক এলাকায় আধপাকা ধান তলিয়ে গেছে। কৃষিশ্রমিক না পাওয়ায় সেসব ধানের অনেকটাই ঘরে তোলা যায়নি। আবার পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় ঘরে তোলা ধানও ঠিকমতো শুকানো যায়নি। এতেও অনেক ধান নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ধান রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখিনি। এরপরও আশাবাদের জায়গা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশে দেড় লাখ টন বোরোর উৎপাদন বেশি হবে। কিন্তু এতে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা দেখতে চাই, অতীতের সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদনটা যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে উদ্যোগ গ্রহণ করুক।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে খাদ্যসংকটের পেছনে বড় কারণ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সে বছর ঘূর্ণিঝড় সিডর হয়েছিল, তার আগে পরপর দুটো বন্যা হয়েছিল। আবার ঘূর্ণিঝড় আইলা হয়েছিল। পরপর এতগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধানের ফলনে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল। আবার সেবার ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে উৎপাদন কম হয়েছিল। ভারত তাদের নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে চাল রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছিল। এ কারণে সরকারি পর্যায়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে মাথা ঠুকেও এক ছটাক ধান আমদানি করা যায়নি সেবার। এবারেও যে দুর্যোগ আসবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। দুর্যোগ এল কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু সেটা যাতে পুষিয়ে নেওয়া যায়, তার আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে। কিন্তু সেই প্রস্তুতির নমুনা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? করোনা মহামারিতে স্রেফ আমাদের দেশের ১৮ কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল কৃষি উৎপাদন। চারপাশে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন স্থবির, তখন সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষারাই নিরলস পরিশ্রম করে ধান, সবজি ফলিয়ে সারা দেশের মানুষের মুখে খাদ্য জুগিয়েছিলেন।

যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সংকটটা যেমন দীর্ঘায়িত হবে আর তাতে নানামুখী বিপর্যয়ও ডেকে আনবে। ইউরোপ-আমেরিকায় এরই মধ্যে মন্দার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এতে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া, রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়া এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মতো সংকটগুলো বাড়তেই থাকবে। নানামুখী এ সংকটে উন্নয়নের ‘দুয়োরানি’ কৃষি (জিডিপিতে মাত্র ১৫ শতাংশ অবদান বলে কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই তাচ্ছিল্য করেন) বরাবরের মতো আমাদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

মূল্যস্ফীতির কারণে একধাপে প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা কয়েক কোটি মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারি উদ্যোগ কী নেওয়া হচ্ছে, সেটা জনগণকে জানাতে হবে। ‘সংকট নেই, দেশের কোথাও হাহাকার নেই, অভাব নেই, হতাশা নেই’ কিংবা ‘মানুষ মনের সুখে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফিরছে’—মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষের ‘কাঁচা ক্ষতে নুনের ছিটা’ দেয়। দেশে কোথাও হতাশা নেই, হাহাকার নেই, সেটা সত্যি হতে পারে, ওপরের কয়েক শতাংশ উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে শুধু বিশ্ব বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একমাত্র কারণ নয়, উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভোক্তাব্যয় বেড়ে যাওয়াটাও একটা বড় কারণ। মন্ত্রীরা যদি শুধু তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা!

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
monoj.dey@prothomalo.com