চৈত্র মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কিছু বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার নদীসংলগ্ন বেশ কয়েকটি মৌজায়। হরিশ্বর মৌজা থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গজেন্দ্রনাথ রায় ফোন দিয়ে বললেন, ‘অবস্থা খুব খারাপ। পানি বের হইতে না পারলে সব ধান ডুবি যাইবে।’ মোমিনুল ইসলাম বলছেন, ‘দুই একর জমিত ধান লাগাইছি, পানিত ডুবি গ্যালো। কইলাজাখান ফাটি গ্যালো।’ সরেজমিন অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম গত সপ্তাহে। দেখলাম, ইটাকুড়ি নামক নিম্নাঞ্চলে কোনো কোনো ধানখেত পানির নিচে।
অনেকগুলো ধানখেত ডুবে যায়নি, কিন্তু ফসল শেষ। কেবলই থোড় (ধানের গর্ভাবস্থা) এসেছে। সেগুলো পানির নিচে। প্রবীণ কৃষক হাশেম আলী বললেন, ‘এই ধানগুলা আর হবার নয়। সাদা চিটা হইবে।’ সুরেশ নামের এক প্রান্তিক কৃষক আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘১৬ হাজার টাকা গ্রামীণ ব্যাংক থাকি লোন নিয়া চাইর বিঘা জমি আধি আবাদ করছি। সোগ পানিত তলে গ্যালো। লোন শোধ করমো কী দিয়া?’
পানি বাড়তে থাকায় চাকিরপশার নদীসংলগ্ন হাজার হাজার মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে। কিন্তু মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের জেলা প্রশাসন কিংবা দুই কিলোমিটার দূরে উপজেলা প্রশাসনকে এই আহাজারি স্পর্শ করতে পারে কি না, সন্দেহ। এই এলাকায় আগাম বৃষ্টি হলে বোরো মৌসুমের ধান পাওয়া যায় না, আর বর্ষায় ডুবে যায় আমন ধান। কৃষিনির্ভর মানুষগুলোর দুঃখ দেখার যেন কেউ নেই।
পানি বাড়তে থাকায় চাকিরপশার নদীসংলগ্ন হাজার হাজার মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে। কিন্তু মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের জেলা প্রশাসন কিংবা দুই কিলোমিটার দূরে উপজেলা প্রশাসনকে এই আহাজারি স্পর্শ করতে পারে কি না, সন্দেহ। এই এলাকায় আগাম বৃষ্টি হলে বোরো মৌসুমের ধান পাওয়া যায় না, আর বর্ষায় ডুবে যায় আমন ধান। কৃষিনির্ভর মানুষগুলোর দুঃখ দেখার যেন কেউ নেই। এ বছর আর দু-এক দিন বৃষ্টি হলে হাজার হাজার একর ধানের ফসল জলাবদ্ধতায় ডুবে যাবে। এত সুন্দর ফসলের খেত ডুবে গেলে কৃষকেরা সইবেন কীভাবে? আকাশে মেঘ দেখলেই তাঁরা স্রষ্টাকে স্মরণ করেন।
রাজারহাট উপজেলার পাঠাহাট নামক স্থানে ৩৫-৪০ বছর আগে নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করার পর থেকেই এ অঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শুরু। ২০১৯ সাল থেকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চাকিরপশার সুরক্ষার জন্য কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনকে অনেকবার চিঠি দিয়েছে। কমিশন সেতু দিতে বলেছে, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে বলেছে, চাকিরপশার বন্দোবস্ত বাতিল করতে বলেছে। জেলা প্রশাসন নির্বিকার। শেষ পর্যন্ত গত বছর নভেম্বর মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে গঠিত একটি কমিটি চাকিরপশার সরেজমিন পরিদর্শন করে গেছে। যখন তারা সরেজমিন তদন্ত করে, আমি ওই দলের সঙ্গেই ছিলাম। গত ডিসেম্বর মাসে ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইটাকুড়ি থেকে উলিপুরের থেতরাই পর্যন্ত পানির প্রবাহ বাধাহীন করার কথা বলা হয়েছে। আড়াআড়ি সড়কের স্থানে প্রবাহের মাপ অনুযায়ী সেতু বানানোর নির্দেশনা দিয়েছে। যে স্থানে ছোট সেতু করা হয়েছে, সেখানে বড় সেতু করার কথা বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনেও জানা যায় আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ এবং অবৈধ দখল প্রক্রিয়ার কারণে উন্মুক্ত জলাশয় বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিয়েছে। এটাকে উন্মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এখানে যে বন্দোবস্ত দেওয়া আছে, তা বাতিল করার কথাও বলা হয়েছে।
চাকিরপশার ছিল হাজার হাজার মৎস্যজীবীর জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা আর নদীতে নামতেও পারেন না। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ২০ জন অমৎস্যজীবীকে চাকিরপশার ১৪১ একর ‘চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড’কে বন্দোবস্ত দিয়েছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বন্দোবস্তগ্রহীতার বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের সমিতিতে যাঁদের নাম আছে, তাঁদের কারও নাম উপজেলা মৎস্যজীবীদের তালিকায় নেই। প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, স্মারকবিহীন ওই তালিকা মৎস্য অফিস প্রদান করেনি। জেলা প্রশাসন থেকে ওই অমৎস্যজীবীদের সঙ্গে চুক্তিনামা ছাড়াই বন্দোবস্ত দেওয়ার অভিযোগ আছে। সমিতিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, জনপ্রতিনিধিও আছেন। একটি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনপ্রতিনিধি সাক্ষাৎকারে বলছেন, তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে তিন বছর মাছ চাষ করার সুযোগ চেয়ে অনুরোধ জানিয়ে এসেছেন। যেহেতু জেলা প্রশাসক অমৎস্যজীবীদের উচ্ছেদ করছেন না, সে কারণে মনে হচ্ছে ওই জনপ্রতিনিধির অনুরোধ তিনি মেনে নিয়েছেন।
চাকিরপশার নিয়ে প্রথম আলোসহ অনেক গণমাধ্যমে বড় বড় খবর প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমারই একটি লেখার সূত্র ধরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীটির বিষয়ে তৎপর হয়। এ পর্যন্ত অনেকবার চিঠি দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ভূমি মন্ত্রণালয়ও একবার চিঠি দিয়েছে। সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে করণীয় ঠিক করে দিয়েছে। তারপরও জেলা প্রশাসনের ঘুম ভাঙে না। এর প্রধানতম কারণ, জবাবদিহি না থাকা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির পক্ষে চাকিরপশার সুরক্ষার জন্য লিগ্যাল নোটিশও দিয়েছে।
উলিপুর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত বুড়িতিস্তা ছিল নদীর উজানের অংশ চাকিরপশার। রাজারহাট সদর এবং চাকিরপশার ইউনিয়নে এর নাম চাকিরপশার, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে এর নাম মরা তিস্তা এবং নাজিমখানও ও থেতরাই ইউনিয়নে এর নাম বুড়িতিস্তা। ইটাকুড়ি নামক নিম্নাঞ্চল থেকে একটি পানির প্রবাহ শুরু হয়েছে। এই প্রবাহটি ছাটমল্লিক বেগ, নাফাডাঙা, খালিসা, সওদাগড়, চাকিরপশার পাঠক, চান্দামারী, মন্দির, বার সুদাই, অর্জুন, সোমনারয়ন, রামকৃষ্ণ, নাজিমখান, উত্তর দলদলিয়া, দক্ষিণ দলদলিয়া মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উলিপুর উপজেলার থেতরাই নামক স্থানে তিস্তা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সিএস নকশায় এটি সম্পূর্ণ পথ নদী হিসেবে না থাকলেও বাস্তবে প্রবাহ এখনো বিদ্যমান। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই প্রবাহ নদীর সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। সহজ কথা, নদী হোক, বিল হোক, খাল হোক, আর নালাই হোক, প্রবাহটি বজায় রাখা জরুরি।
এই প্রবাহপথে নাফাডাঙা, খালিসা, সওদাগড়, চাকিরপশার, চান্দামারী—এই পাঁচ মৌজার অংশ সিএস নকশায় বিল শ্রেণীভুক্ত হিসেবে উল্লেখ আছে। কুড়িগ্রাম জেলার প্রশাসনের ভিন্ন ভিন্ন চিঠিতে এই বিলের পরিমাণে তারতম্য দেখা যায়। তাদের একবারের চিঠি অনুযায়ী এর আয়তন ৩০৬ একর, আরেকবারের চিঠিতে ২৭৯ একর বলা হয়েছে। তবে ৩০৬ একর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জেলা প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী এর মধ্যে প্রায় ১৪১ একর ব্যক্তির নামে রেকর্ড করা হয়েছে। এই রেকর্ড করে দেওয়ার মতো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ যারা করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
অবৈধ দখলদারের তালিকা কখনো ২২ জনের, কখনো বলা হচ্ছে শতাধিক ব্যক্তির।
সহকারী ভূমি কমিশনার কিছু কিছু রেকর্ড সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন অবৈধ দখলদারকেও উচ্ছেদ করা হয়নি। উল্লিখিত তদন্ত কমিটি পর্যবেক্ষণের ৩ নম্বরে বলেছে, ‘সিএস রেকর্ডের মালিক জমিদার, শ্রেণি বিল উল্লেখে রেকর্ডভুক্ত আছে এবং যেহেতু ১৯৫০ সালের জমিদারি ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৩ (২) ও ২০ (২ ক) ধারামতে বিল শ্রেণি জমির মালিক নিরঙ্কুশ সরকার সেহেতু বর্ণিত জমি এসএ রেকর্ডে ব্যক্তির নামে বেআইনি, প্রতারণামূলক ও সরকারি স্বার্থের পরিপন্থী।’ বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৩২ নম্বর ধারা অনুযায়ী এই সম্পদের মালিক জনগণ। তাহলে যারা বেআইনি, প্রতারণামূলক, সরকারি আইনের পরিপন্থী কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা জরুরি।
জলাবদ্ধতা দূরীকরণে, পানির প্রবাহ বাধাহীন করতে, বন্দোবস্ত বাতিলকরণে দায় এবং দায়িত্ব উপজেলা-জেলা প্রশাসনের। সংশ্লিষ্টজনেরা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন না করলে তাদের বাধ্য করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com