সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে এক তরুণের বক্তৃতা শুনছিলাম। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের কর্মী তিনি। তরুণটি বলছিলেন, মা তাঁর হাসপাতালে। সকালে মাকে ওষুধপথ্য খাইয়ে এখানে এসেছেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ঘরে অর্থ নেই। শিক্ষাজীবন তাঁর অনিশ্চিত। তরুণটি কয়েকটি পত্রিকার নাম করছিলেন, যেখানে তাঁদের আন্দোলনের খবর অল্প হলেও বেরিয়েছে।
ওই দিন প্রেসক্লাবের সামনে আরও কয়েকটি সংগঠন তাদের দাবিদাওয়ার জানান দিতে এসেছিল। এর মধ্যে ওই তরুণদের আয়োজনটি ছিল ছোট পরিসরে। জনা চল্লিশেক ছেলেমেয়ে, একটি মাত্র মাইক। তাঁদের কথাগুলো বেশি মানুষের মনোযোগ টানতে পেরেছিল বলে মনে হয়নি।
এই ছেলেমেয়েরা অনেক দিন ধরেই কথা বলে চলেছেন। কখনো সমাবেশ, কখনো মানববন্ধন, কখনো অবস্থান ধর্মঘট করে তাঁরা সদাশয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কয়েক বছর ধরেই তাঁদের জমায়েত কখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, কখন শাহবাগ মোড়ে। শনিবারও (১০ মার্চ) তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে বাংলামোটর এলাকায় পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন। আন্দোলনরত মেয়েদের নির্যাতিত হওয়ার দৃশ্য আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি।
২.
বর্তমান বিধি অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে তা ৩২। অর্থাৎ সাধারণ ক্ষেত্রে বয়স ৩০ বছর পার হলে আর কেউ সরকারি চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে পারবেন না। তাঁকে দৌড়াতে হবে বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো উপায়ে রুটিরুজি জোগাড়ের দিকে।
এই তরুণেরা চান, বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩০–এর জায়গায় ৩৫ করা হোক। কারণ, সেশনজটের বেড়া ডিঙিয়ে তাঁদের স্নাতক/স্নাতকোত্তর শেষ করতেই বয়স ২৭ বা ২৮ হয়ে যায়। তাই চাকরিতে প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে নিতেই বয়স ৩০-এর কাছাকাছি এসে পড়ে।
একটা সময় এ দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর। পরে এটা বাড়িয়ে ৩০ করা হয়। তার মানে কমানো-বাড়ানোর সুযোগ সব সময় আছে। এ দেশে সরকারি চাকরি পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।
সরকারি চাকরি এ দেশে মর্যাদার, গর্বের।
সরকারি চাকরি এ দেশে লোভনীয়।
সরকারি চাকরি মানে নিশ্চিন্ত একটা জীবন পার করে দেওয়া।
সরকারি চাকরির কোনো খারাপ দিক নেই।
সরকারি চাকরির আগাগোড়া সব ভালো।
এই কারণেই আমাদের ছেলেরা, মেয়েরা আজ রাস্তায়। তাঁরা আন্দোলনে। এখন প্রশ্ন, তাঁদের এই ৩৫ করার দাবি কতটা যৌক্তিক? আমার কাছে একটি কাগজ আছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের অনেক দেশই এ ক্ষেত্রে উদার। যেমন আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। সেখানে চাকরিভেদে সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২৪ থেকে ৪০ বছর। আরেক প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় তা আরও পাঁচ বছর বেশি।
যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, তারা আরও উদার। এ দেশে যে বয়স হলে সরকারি কর্মচারীদের ছাতা, লাঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় সে বয়সেও চাইলে চাকরিতে ঢোকা যায়।
এবার তাকাই ইউরোপে। ইতালি ও নরওয়েতে এ বয়স ৩৫। ফ্রান্সে ৪০, আর সুইডেনে ৪৭ বছর। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশগুলো ৫৫ বছর পর্যন্ত তার নাগরিকদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।
এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, বাইরের দেশগুলোতে যে নিয়ম আছে, আমাদেরও তাই করতে হবে? নিশ্চয়ই নয়। আবার অন্য দেশের উদাহরণ থেকে আমরা যে কিছু নেব না, এমন মনোভাবও যৌক্তিক মনে হয় না। শেখার কোনো বয়স নেই এ কথা যেমন সত্য, তেমনি তরুণ বয়সে যতটা শেখা যায়, পরবর্তী সময়ে আর তা হয় না, তাও সত্য।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর প্রসঙ্গ আসছে প্রধানত সেশনজটের কারণে। একজন শিক্ষার্থী যদি ২৩ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারতেন, তাহলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বেঠিক ছিল না। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করতে আরও দুই–তিন বছর বেশি লাগছে। এর মধ্যে আবার রকমফের আছে। সম্ভবত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি ত্যাগ স্বীকার করছেন। তাঁদের মধ্যে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণাটা আরেকটু তীব্র। তাঁরা গড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কলেজের তুলনায় ছয় মাস থেকে এক বছর পিছিয়ে পড়ছেন।
যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সেশনজট তুলনামূলক কম। ১৯৮০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোতে একজন শিক্ষার্থীর ছয় থেকে সাত বছর লাগত। রাজনীতির মাতাল হাওয়ার দাপটে চরম সেশনজট ছিল রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেই সময় তো এখন নেই। এখন সুস্থির রাজনীতি! এখন স্নাতক চার বছর হওয়ার পরেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা গড়ে ছয় বছরের মধ্যে বেরোতে পারছেন। কোথাও কোথাও আরেকটু বেশি লাগছে বটে।
৩.
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য যারা আন্দোলন করছেন, তপ্ত দুপুরে পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করছেন, আটকের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের প্রতি আপনা–আপনি সহানুভূতি চলে আসে। তবে দাবি আদায়ের জন্য ব্যস্ত সড়ক আটকে নাগরিক জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করা গ্রহণযোগ্য নয়।
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শিথিল থাকা উচিত। কেউ যদি ৪০ বছর বয়সে সব ধরনের পরীক্ষায় উতরে সরকারি চাকরিতে আসতে চান, তাঁর যদি সব ধরনের যোগ্যতা থাকে, তাহলে তাঁর অধিকার হরণ কেন?
বাস্তবতা হচ্ছে, সদাশয় কর্তৃপক্ষ যদি সেশনজট একবারে কমিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে আর এই আন্দোলনকারীদের দাবির সারবত্তা থাকে না। সেশনজট আছে বলেই এই দাবিটা আসছে।
সরকার এই ছেলেমেয়েদের দাবি মেনে নিন বা না নিন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া, কথা বলা জরুরি। আলোচনা হোক সরকারি মহলে, আলোচনা হোক বেসরকারি মহলে। সেমিনার, গোলটেবিলে বিস্তর আলোচনা, তর্ক হোক। যা কিছু সিদ্ধান্ত, এর ভিত্তিতেই হোক।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
alimkzaman@gmail.com