সরকারি নিয়োগ

চাকরিতে কোটা বিরোধিতার যুক্তি

আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল

আমাদের সংবিধানে আছে, মানুষে-মানুষে বৈষম্য করা যাবে না। নারী-পুরুষে বৈষম্য করা যাবে না, ধর্ম-বর্ণভেদে করা যাবে না। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা জন্মস্থানভেদে বৈষম্যও নিষিদ্ধ করে গেছেন। সে অনুযায়ী, দেশের কোনো বিশেষ জেলায় জন্মস্থান হলে কেউ বাড়তি সুবিধা পেলে তা হবে অন্যদের জন্য বৈষম্য। সংবিধান অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে অনগ্রসর (সংবিধানের ভাষায় পশ্চাৎপদ) মানুষের জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে বলেছে। যেমন নারীদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার ব্যবস্থা। তবে সেটিও বলেছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, অর্থাৎ তাঁদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত।

অথচ বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে কোটার ব্যবস্থা আছে এমন বহু মানুষের জন্য, যাঁরা কোনোভাবেই অনগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না। এই কোটাও আবার এত বেশি হারে (মোট চাকরির ৫৫ শতাংশ), যার নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোটা নিয়ে তাই মাঝে মাঝেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এ দেশের তরুণ সমাজে। নানান যুক্তি দেখিয়ে কোটার পক্ষে দাঁড়ানোর কিছু মানুষও আছে সমাজে। কিন্তু এদের এসব যুক্তির কোনো সারবত্তা নেই সংবিধান, ন্যায়নীতি বা বৈশ্বিক প্রবণতার মানদণ্ডে।

২.
বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয় মেধার ভিত্তিতে, বাকি ৫৫ জনই কোটার ভিত্তিতে। সাধারণত এই ৫৫ ভাগের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা-সন্তান কোটায় ৩০ ভাগ, শুধু জেলা কোটায় ১০ ভাগ, নারী কোটায় ১০ ভাগ এবং উপজাতি কোটায় ৫ ভাগ নিয়োগ করা হয়। কোটার কারণে দেখা যায়, মেধার তালিকায় কয়েক হাজার স্থানে পেছনে থাকা কেউ চাকরি পেয়ে যায়, আবার মেধাতালিকায় কয়েক হাজার ওপরে থেকেও বাকিরা বঞ্চিত হয়।

এই বিপুল বৈষম্যের কারণে কোটাব্যবস্থা নিয়ে সিরিয়াস গবেষণাকর্মেও প্রশ্ন উঠেছে। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলি খান রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান হিসেবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। এতে বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে, নারী কিংবা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে ‘উপজাতিদের’ জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশের’ জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে, ‘অনগ্রসর অঞ্চলের’ জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি নেই বলা যায়। সংবিধান অনুসারে মুক্তিযোদ্ধা কোটারও কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাই মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে তাঁদের সন্তানেরা ঢালাওভাবে অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে আরেকটি আপত্তি করা হয়-এতে জালিয়াতি বা দুর্নীতির সুযোগের কারণে। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও টাকা বা সম্পর্কের জোরে ভুয়া সার্টিফিকেট জোগাড় করে সরকারি চাকরি বাগিয়ে নেওয়া সম্ভব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের। আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যে দেশে রয়েছে, তার একটি বড় প্রমাণ বিভিন্ন আমলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি। ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩। পরে বিভিন্ন সময়ে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বর্তমান সরকারের প্রথম দিকের একটি তালিকায় ২ লাখ ২ হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। তাদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে এই মর্মে আপত্তি দাখিল হয় ৬২ হাজার।

এসব আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে কি না বা পরবর্তী সময়ে আরও যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাঁরা আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কি না, এই সংশয় কখনো দূর হয়নি।

৩.
১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে কিছু বলা নেই। এই সংবিধান প্রণীত হয়েছিল যে গণপরিষদে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে কোটা প্রদানের কথা উত্থাপিত হয়নি। গণপরিষদে কেবল সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)। সামাজিক নিরাপত্তার উদার ব্যাখ্যা করলে শুধু পঙ্গু বা নিহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের জন্য চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ তাই বৈধ হতে পারে, অন্যদের জন্য নয়।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে অবশ্য ১৯৭২ সালে প্রণীত ইন্টেরিম (বা অন্তর্বর্তীকালীন) রিক্রুটমেন্ট পলিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়। এটি ইন্টেরিম বলার মানেই হচ্ছে কোটা স্বল্পসময়ের জন্য প্রযোজ্য রাখার চিন্তা ছিল তখন। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন বাদে বাকি সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের ওই সদস্য অবশ্য ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন।

কিন্তু ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়, পরে তাঁদের পাওয়া না গেলে তাঁদের জন্য নির্ধারিত পদগুলো শূন্য রাখার নীতি গৃহীত হয়। আরও পরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ মারাত্মকভাবে সংকুচিত করা হয় কোটাধারীদের স্বার্থে।

৪.
কোটাব্যবস্থার সমর্থকেরা অন্যান্য দেশেও কোটা আছে বলে যুক্তি দেখান। কিন্তু আমার জানামতে, আমাদের মতো ঢালাও কোটাব্যবস্থা অন্য কোথাও নেই। ভারতের উদাহরণ দিই। ভারতে কোটাপদ্ধতি পরিচিত রিজারভেশন বা সংরক্ষণ নামে। সেখানে সংবিধান অনুসারে শুধু তালিকাভুক্ত নিম্নবর্গ ও উপজাতি শ্রেণিদের জন্য সরকারি চাকরি, জনপ্রতিনিধিত্ব এবং উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোটার ব্যবস্থা রয়েছে। পরে মানডাল কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯২ সাল থেকে সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত পেশার মানুষের (যেমন কৃষিশ্রমিক, নাপিত, ধোপা ইত্যাদি) সন্তানদের জন্যও কোটার ব্যবস্থা করা হয়।

২০০৬ সালের এক জরিপ অনুসারে সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষ ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ হলেও তাদের জন্য কোটা রাখা হয়েছে ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে শিডিউলড কাস্ট ও ট্রাইব জনগোষ্ঠী ২৯ শতাংশ, বিপরীতে কোটা রয়েছে ২২ শতাংশের মতো। সেই তুলনায় বাংলাদেশে নারী ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার পরিমাণ কম হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি। তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ হলেও তাঁদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রয়েছে ৩০ শতাংশ!

৫.
ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে বাংলাদেশে কোটাব্যবস্থার সংস্কার আনা জরুরি। বর্তমান কোটাব্যবস্থায় শুধু যে বেসামরিক প্রশাসনের মান খর্ব হচ্ছে তা-ই নয়, এতে সমাজে চরম বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হচ্ছে-যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে দেশের জন্য যুদ্ধাহত ও নিহত হয়েছেন। এসব মুক্তিযোদ্ধাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুধু তাঁদের সন্তানদের জন্য সমানুপাতিক কোটা রাখার দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে। অন্যান্য কোটার মধ্যে জেলা কোটা বাতিল করা উচিত। নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোটা অব্যাহত রাখা উচিত, প্রতিবন্ধীদের জন্য সীমিত কোটার ব্যবস্থাও সরকার করতে পারে। তবে কোনো বিচারেই কোটাধারীর সংখ্যা মোট নিয়োগের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়া উচিত হবে না।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক