বাড়ছে বাংলাদেশ

চাই টেকসই কর্মপরিকল্পনা

.

প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, বিগত ৩২ বছরের বেশি সময় ধরে স্যাটেলাইটের ছবিসহ অন্যান্য স্থানীয় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জানা গেছে, বাংলাদেশে বছরে ১৬ থেকে ২০ বর্গকিলোমিটার হারে নতুন ভূমি সংযোজিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, নদীপথে হিমালয় থেকে বয়ে আসা পলি এই নতুন চর জেগে ওঠার প্রধান কারণ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের বুকে প্রায় ১ হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি জেগে উঠবে।
একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির দরুন দেশ ভূমি হারাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তীরবর্তী লাখো সাধারণ মানুষ; অন্যদিকে নতুন ভূমির সংযোজিত হওয়ার খবর (ঢাকা শহরের প্রায় পাঁচ গুণ) আমাদের আশান্বিত করে নতুন একটি উন্নয়নের সূচনায়। কিন্তু সব থেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সত্যিই বাংলাদেশের বুকে আরেকটি ছোট বাংলাদেশ জেগে ওঠে, তাহলে কোন কোন উপায়ে আমরা সেটির টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে পারি—দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে? এই পরিকল্পনা আমাদের এখন থেকেই করতে হবে। সব মহলকেই গুরুত্বসহকারে বিষয়টি ভাবতে হবে। বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, স্থানীয় ভূমি ব্যবহার ও আচ্ছাদনে সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাবে টেকসই উন্নয়নে অনেক ক্ষেত্রে আমরা বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তাই আমাদের প্রথম যেটা করতে হবে তা হলো, প্রায়োগিক সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থাপনা-পরিকল্পনা এবং জেগে ওঠা নতুন ভূমির স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি নেটওয়ার্কিং, যার মাধ্যমে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ও বাস্তু পরিষেবার টেকসই ব্যবস্থাপনা সম্ভব।
অনুমান করা হয় যে সরাসরি মানুষের পায়ের চাপে বিশ্বব্যাপী ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৮৩ শতাংশ প্রভাবিত হয়েছে এবং এ কারণে প্রায় ৬০ শতাংশ বাস্তুতন্ত্র বিগত ৫০ বছরে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সুতরাং ভূমি ব্যবহার ও আচ্ছাদন বর্তমানে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান মূল চালিকা শক্তি, যাকে ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে উন্নত-অনুন্নত প্রায় সব দেশেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী একে বাস্তবসম্মত করা সম্ভব হয়নি।
সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে নতুন জেগে ওঠা চর বা ভূমির ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের মধ্যে যে বিষয়টিকে প্রায়োগিক দিকে প্রাধান্য দিতে হবে তা হচ্ছে ভৌগোলিক-পরিবেশগত সম্পূরক সম্পর্ক স্থাপন এবং পূর্ণাঙ্গ একটি প্রায়োগিক মডেল প্রণয়ন, যা ভবিষ্যতে বিশেষ পদ্ধতিতে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়িয়ে খাদ্য উৎপাদনে বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে।
অন্যদিকে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ভূমি ব্যবহারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে মৌলিক আরেকটি বিষয় হিসেবে দেখা উচিত বৈকি! যা বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নতুন কোনো চর জাগলে স্বভাবতই সেখানে জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন এমনকি মাটিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ মানুষের শরীরে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরামর্শক, মনিটরিং সেল ও স্থানীয় গবেষণা সেল প্রস্তুত করা যেতে পারে সরকারি কিংবা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে।
নতুন চর একদিকে যেমন আমাদের মাঝে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে, ঠিক তেমনি চরসংলগ্ন জলাশয়ের প্রকৃতি যেন বিনষ্ট না হয় সেদিকেও সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে, জলাশয় সংরক্ষণ সুষম নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে। বিশেষ করে আমাদের দেশের জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী জলাশয়-জীববৈচিত্র্যভিত্তিক সবুজ অর্থনীতি তৈরি করা যেতে পারে, যা সাধারণত জাপানসহ উন্নত অনেক দেশেই বিশেষভাবে বিবেচনাধীন এবং দিনে দিনে প্রায়োগিক হয়ে উঠছে। এই রূপান্তরের অনেক বাস্তব ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতা রয়েছে, এমনকি ঝুঁকিও রয়েছে অনেক, সে ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই সুযোগকে মূল্যায়ন করা। অনেক দেশেই দেখা গেছে, এসব নতুন জেগে ওঠা ভূমিতে প্রথমত, উপযুক্ত বনায়ন করে থাকে মাটিকে ধরে রাখার জন্য এবং পরবর্তী সময়ে সেখানে যাতায়াতের সুব্যবস্থার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থারই টেকসই উন্নয়নের অনন্য এক পন্থা বলে বিবেচ্য। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর কথা ভুলে গেলে চলবে না—যারা তাদের বসতি, কৃষিজমি, ভিটামাটি হারাচ্ছে—তাদের স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী পুনর্বাসনও টেকসই উন্নয়নের একটি বড় অংশ বলে প্রতীয়মান হবে, যার পরিকল্পনা এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। আর সঠিকভাবে এই জেগে ওঠা ভূমিকে কাজে লাগাতে পারলে এবং একে স্থায়ী করতে পারলে সম্ভবত সেটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত সমস্যা মোকাবিলা করে তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোকে সুরক্ষিত রাখবে।
গেইটসের (২০১১) তথ্যমতে, দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছ থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও টেকসই উন্নয়নে এসব বেড়ে ওঠা ভূমিকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার নিরীক্ষা চালানো যেতে পারে স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে। কারণ, সামনের দিনগুলোতে সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও খাদ্য উৎপাদনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে, এটিই হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দীর্ঘতম বিনিয়োগের খাত। প্রয়োজনে উপযুক্ত উন্নয়ন বৃদ্ধিজনিত সূচক নির্ধারণ করতে হবে, যা ওই অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন—দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারসহ জীবন মান বিকশিত করবে।
সবশেষে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট গবেষণা ইউনিট তাদের গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন মডেল সরকারের সামনে উপস্থাপনা করতে পারে, স্থানীয় গবেষকদের সহযোগিতায়, যা থেকে বাস্তব ও প্রায়োগিক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আর এর জন্য অবশ্যই প্রথমে প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।