চাই টিভি দর্শক ফোরাম

.

‘এফটিপিও’র একটি দাবি: ‘বিদেশি টিভি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করা যাবে না।’ প্রথমত এটা একটা সরকারি নীতির প্রশ্ন। ‘এফটিপিও’ এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো হতো। বিদেশি ছবি, টিভি সিরিয়াল ও টিভি অনুষ্ঠান ডাবিং করে প্রচারের ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কি কোনো নীতিমালা আছে? যদি না থাকে, তাহলে ডাবিং সিরিয়াল প্রচার করে কোনো টিভি চ্যানেল কোনো অন্যায় করেনি। আন্দোলনটা হওয়া উচিত একটি নীতিমালার দাবিতে। সেই নীতিমালায় থাকতে পারে দিনে সর্বোচ্চ কত ঘণ্টা ডাবিং অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে, কী ধরনের অনুষ্ঠান ডাবিং করা যাবে ইত্যাদি। তবে এ রকম নীতিমালা করার সময় চ্যানেল–মালিকদের পাশাপাশি দর্শকদেরও ডাকতে হবে। নিরপেক্ষ হিসেবে টিভি বিশেষজ্ঞ, সমাজ বিশেষজ্ঞ ও সমাজের গণমান্য নাগরিকদেরও মতামত নিতে হবে। কারণ, টিভি একটি সামাজিক মাধ্যম। এফটিপিও মাত্র একটি পক্ষ। ‘জাতীয় সম্প্রচার কমিশন’ যত দিন গঠিত হচ্ছে না, তত দিন তথ্য মন্ত্রণালয়কে এসব সমস্যার সমাধান দিতে হবে।

এফটিপিওর আন্দোলনে কোনো কোনো কর্মী ‘দীপ্ত টিভি’ বন্ধেরও দাবি তুলেছেন। (সূত্র: প্রথম আলো) আমরা মনে করি, এ রকম দাবি তোলা অন্যায়, অনভিপ্রেত। এ ধরনের দাবি বা বক্তব্য আলাপ-আলোচনার পরিবেশ নষ্ট করে।

আজ যদি প্রস্তাবিত টিভি দর্শক ফোরাম, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সামনে মানববন্ধন করে দাবি জানায়: ‘দুর্বল টিভি নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করুন।’ তাহলে এফটিপিও কী বলবে? চ্যানেল কর্তৃপক্ষও বা কী বলবে?

টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষেরও এই প্রসঙ্গে নানা বক্তব্য থাকতে পারে। কোনো নীতি করার আগে মন্ত্রণালয়কে সেটাও শুনতে হবে। বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ। এখানে সরকার টিভি চ্যানেলের ব্যবসায় বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। তা ছাড়া লাইসেন্স ছাড়া টিভি চ্যানেলকে সরকার কোনো সহযোগিতা করে না। কাজেই সরকারের খবরদারি এখানে তেমন কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বিদেশি অপসংস্কৃতি প্রচার প্রশ্নে সরকার কিছু নীতিমালা করতে পারে। সরকার ‘বিটিভি’র জন্য যত খুশি নীতিমালা তৈরি করুক, তাতে কেউ কিছু বলবে না। উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ে সরকারের নীতিমালা মেনে প্রাইভেট টিভিকে অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। এর বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে নীতিমালা করতে চাইলে টিভি চ্যানেল তা মানবে কেন?

একটা কথা মোটামুটি সব পক্ষই মেনে নিয়েছে। তা হলো, ‘আমাদের দর্শকেরা বাংলাদেশি চ্যানেলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’ এখন সবাই মিলে (সব পক্ষ ও সরকার) গবেষণা করে বের করুক, কী কী পদক্ষেপ নিলে দর্শকেরা আবার বাংলাদেশি অনুষ্ঠানে ফিরে আসবেন। ব্যাপক মতামত জরিপ ও ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হয়তো আমরা জানতে পারব কী কী পদক্ষেপ নিলে দর্শকেরা আবার বাংলাদেশি টিভি অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী হবেন।

‘বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট’ ও ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট’ যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করলে হয়তো বিজ্ঞানসম্মত একটা রিপোর্ট আমরা পেতে পারি। বিক্ষোভ, মানববন্ধন বা গোলটেবিল করে এত বড় সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। তবে সাদামাটা চিন্তায় দর্শক ফিরিয়ে আনার জন্য কয়েকটি সমাধানের কথা আমরা এখানে বলতে পারি। ১. প্রতিটি টিভি অনুষ্ঠানের শুরু ও শেষ ছাড়া কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। বিজ্ঞাপন প্রচারের রেট বর্তমান রেটের তিন গুণ হবে। অনুষ্ঠানের মাঝখানে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। ২. টিভি অনুষ্ঠান (বিশেষ করে নাটক) প্রচারের সময় কোনো স্ক্রল বা সাইড বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। ৩. ঘোষিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ৪. নাটক, সিরিয়াল ও দিনের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান সম্পর্কে ওই দিন সকাল থেকে স্ক্রলে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। (এখন কখন কোন চ্যানেলে কী অনুষ্ঠান হয়, তা কেউ বলতে পারে না।) ৫. প্রতিটি অনুষ্ঠানের বাজেট বাড়াতে হবে। সে জন্য বিজ্ঞাপনের রেট বাড়াতে হবে। ৬. শিল্পী ও অন্য কলাকুশলীদের সম্মানী সম্পর্কে একটা নীতিমালা করতে হবে। অনেক শিল্পী, পরিচালক তাঁর ক্যারিয়ারের পাঁচ বছরের মধ্যেই গাড়ি, ফ্ল্যাট—সব দেখতে চান। এই প্রবণতা দূর করতে হবে। অনুষ্ঠানের বাজেট কত হলে কে কত সম্মানী পাবেন, তার একটা অনুপাত থাকা দরকার। ৭. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে হবে। এই বাক্যটি ক্লিশে হয়ে গেছে। তবু এটাই মূল কথা। টিভি মিডিয়া মেধাবীদের জায়গা। মিডিওকারদের জায়গা নয়। কাজেই নাটক রচনা, পরিচালনা, অভিনয়, সম্পাদনা, অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, উপস্থাপনা, সেট, সামগ্রিক প্রডাকশন—সবকিছুই উচ্চ মানসম্পন্ন হতে হবে। দর্শকদের সন্তুষ্ট করা খুব কঠিন কাজ। ৮. বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলে মুড়ি-মুড়কির এক দর। ভালো অনুষ্ঠান প্রচার করলেও বিজ্ঞাপনের যা রেট, খারাপ অনুষ্ঠান প্রচার করলেও একই রেট। তা হবে কেন? তাই এখন ‘পে চ্যানেল’ প্রসঙ্গটা আলোচনায় আনতে হবে। দর্শকেরা টাকা দিয়ে শুধু তাঁর পছন্দের চ্যানেল দেখবেন, যে চ্যানেলে দর্শক বেশি হবে, সেই চ্যানেল বেশি বাজেট দিয়ে ভালো অনুষ্ঠান তৈরি করবে বা কিনবে। যিনি টাকা দিয়ে নির্দিষ্ট চ্যানেল দেখবেন, তিনি ভালো অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাবেন। যেমন গুড় তেমন মিষ্টি। পে চ্যানেল চালু হলে দুর্বল ও অপেশাদার টিভি চ্যানেলগুলো আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। উপমহাদেশীয় প্রতিযোগিতার বাজারে দুর্বল টিভি চ্যানেলের কোনো স্থান হবে না। ৯. পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে আমাদের টিভি চ্যানেল চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ভারতীয় টিভি চ্যানেল এ দেশে সাময়িক বন্ধ করে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো আপস হবে না। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে আমাদের চ্যানেল চললে এখানকার বিজ্ঞাপন ও স্পনসর বাড়তে পারে, রেটও বাড়তে পারে। বিভিন্ন কোম্পানি ওই সব অঞ্চলে তাদের পণ্য রপ্তানি বাড়াতে পারবে। একটার সঙ্গে একটা জড়িত। কাজেই ভারতের এই কয়েকটি অঞ্চলে
আমাদের টিভি চ্যানেল চালানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা নিতে হবে। তথ্য মন্ত্রণালয়কে এর নেতৃত্ব দিতে হবে। কাজটি যদিও প্রাইভেট সেক্টরের। ১০. বেআইনিভাবে বা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতীয় টিভিতে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপ​েনর প্রচার বন্ধ রাখা।

এসব পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বড় কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। তবে বাংলাদেশের নাটক, সিরিয়াল, অন্যান্য অনুষ্ঠান আকর্ষণীয় করতে না পারলে দর্শক কিন্তু দেখবেন না। দর্শক এখন সত্তর বা আশির দশকের দর্শক নন। তখন এক ‘বিটিভি’ দেখে সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন। এখন তাঁদের হাতে শতাধিক চ্যানেল। তাঁদের আটকাতে হলে উচ্চ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। বিক্ষোভ সভা ও মানববন্ধন দিয়ে দর্শক আকর্ষণ করা যাবে না। বরং এতে দর্শকেরা আরও বিরক্ত হচ্ছেন। দর্শকের স্বাধীনতাকে সম্মান দেখাতে হবে।

আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ আরও দ্রুত হওয়া দরকার। সম্প্রতি টিভি মিডিয়া ও চলচ্চিত্র আমদানি-রপ্তানি নিয়ে অনেক
কথা হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয় আরেকটু সক্রিয় হয়ে দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করবে, এটাই প্রত্যাশা।

শুরুতে যে কথাটি লিখেছি, তা আবার বলতে চাই। চলচ্চিত্র ও টিভির জন্য দুটি খুব সক্রিয়, জ্ঞানী ও পেশাদারি দর্শক ফোরাম গঠন করা দরকার। যারা মিডিয়ার বিভিন্ন ইস্যুতে সুচিন্তিত, গঠনমূলক বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। দর্শকদের দাবি বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয় বা চ্যানেল অন্য কোনো ফোরামের দাবি পূরণ করলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ, দর্শক বাংলাদেশের অনুষ্ঠান না দেখলে বিজ্ঞাপনদাতা বা স্পনসর একদিন সরে যাবে। তখন কী হবে? কাজেই দর্শকের চাহিদার কথা সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। দর্শকের চাহিদা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চাই ‘টিভি দর্শক ফোরাম’।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী