মতামত

চাঁদের জমির তেজারতি ও ফটিকলালদের সেকাল একাল

স্ত্রী টুম্পার হাতে ‘চাঁদের জমি’ কেনার কাগজ তুলে দিচ্ছেন অসীম
 ছবি: সংগৃহীত

পটেশ্বরী ওরফে পটুর ঠাকুরমা পটল তোলার পর শ্রাদ্ধের ফর্দ করতে সে গেল পুরোহিত ফটিকলালের কাছে। ফটিকলাল মিষ্টি করে বলল, ‘লিস্টি করে দিচ্ছি। লেখো—চাল ১০ সের, ডাল ৫ সের, ঘি ৫ সের, খড়ম এক জোড়া, কম্বল একটি...’
পটু বলল, ‘ঠাম্মার শ্রাদ্ধে কম্বল লাগবে কেন?’
ফটিকলাল বলল, ‘আঃ হরি! তোমার ঠাম্মা এখন আছে কই জানো?’
—জানি, স্বর্গে।
—আহ হা, স্বর্গে তো বটেই, স্বর্গের কোন এরিয়াতে তা জানো?
—না তো! কোথায়?
—চন্দ্রে। সেইখানে মারাত্মক ঠান্ডা। কম্বলের অভাবে বুড়ি ঠকঠকায়ে কাঁপতাছে। চন্দ্রে তোমার ঠাম্মা জমি কেনার বায়না করছে। বাড়ি তুলবে। কিন্তু টাকার অভাবে জমি কিনতে পারতেছে না। শ্রাদ্ধের সাথে চন্দ্রে তার কাছে কিছু টাকাও পাঠায়ে দিয়ো।’
পটু অবিশ্বাসের সুরে বলল:
—সে কথা তুমি জানলে কী করে?

ফটিকলাল বলল:
—আমার ঠাকুরদা চন্দ্রের সব জমির এজেন্ট। তিনিই খবর দিয়েছেন।
—কী করে খবর পাঠাল?
—পত্রিকায় দেখো নাই? রুশ বিজ্ঞানীরা লাইকা নামের একটা কুত্তা পাঠাইছিল। আমার ঠাকুরদাদা তারে দেইখা ‘বুলু রে! বুলু রে!’ কইরা কাইন্দা উঠছিল। তাই দেইখ্যা যমরাজের মনে খুব দুঃখু হইল। যমরাজ আমার ঠাকুরদারে ডাক দিয়ে কইলেন, ‘পরান রে! দুঃখু করিস না। পৃথিবীর মানুষ শিগগিরই দলে দলে চন্দ্রে আসবে। তুই চন্দ্রের জমির এজেন্ট হ। পৃথিবীর পাবলিক আইলে তাগো কাছ থিকা নগদ টাকা নিবি আর জমি দিবি।
—তারপর?
—তারপর ঠাকুর দাদা লাইকা মারফত রাশিয়ার কাছে খবর পাঠাইছে। রাশিয়ার লোক আমার কাছে খবর পাঠাইছে।
সব শুনে পটু তার ঠাকুরমার জন্য জমি কেনার টাকা আনতে গেল। পটুর কাছে এই খবর শুনে আশি বছরের বদন খুড়া চাঁদের জমি কেনার জন্য এসে হাজির। বদন খুড়া বললেন,
—বাবা ফোকোট লাল!
—খুড়া, আমার নাম ফটিকলাল।
—ওই হলো, একই কথা। তা শুনলাম তুমি নাকি চাঁদের জমির তেজারতি ব্যবসা শুরু করেছ?
—আজ্ঞে, করেছি। জমির দাম খুব সস্তা। মাত্র ৫০ টাকা কাঠা।
—মাত্র ৫০ টাকা কাঠা! বাবা ফোকোটলাল...
—আজ্ঞে, আমার নাম ফটিকলাল!
—অই হলো, তা তুমি আমার জন্য বিঘে কুড়ি জমির ব্যবস্থা করে দাও। এই নাও বায়নার ৫০০ টাকা। আর হ্যাঁ, চাঁদে জমি তো কিনছি, কিন্তু সেখানে যাব কী করে?
—ক্যান, ডবল ডেকার বাঁশে করে যাইবা।
—সেকি! বাস চালু হবে নাকি? কবে থেকে?

—বেশি দেরি নাই। তোমার তো বয়েস ৮০ হইলো। আর কয়টা দিন পরই তোমার বাড়িতে ডবল ডেকার বাঁশ যাইব। ওই বাঁশের হর্ন হইলো ‘হরিবোল’। তুমি বাঁশে উঠলেই সবাই তোমারে ‘হরি হরি বোল! হো...রি. . বোল!’ কইয়া চান্দে পাঠাইয়া দিবো।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গল্প অডিও কৌতুক হিসেবে বাজারে এসেছিল অর্ধশতাব্দী আগে। সেই গল্প তখন স্রেফ গল্পই ছিল। কিন্তু তার বছর দশেক পরই, মানে আশির দশকেই তা তপন সিংহের ছবির মতো ‘গল্প হলেও সত্যি’ হয়ে গেল। আক্ষরিক অর্থে আমেরিকার এক ফটিকলাল ‘চান্দের জমির তেজারতি’ খুলে বসলেন। চাঁদের জমি প্লট আকারে বিক্রি করা শুরু করলেন। এরপর ৪০ বছর কেটেছে। এখন কাস্টমার হিসেবে নতুন যুগের পটেশ্বরী-বদনখুড়ার অভাব নাই। দেদার বিক্রি হচ্ছে চাঁদের জমি।

দুনিয়ার অগুনতি খদ্দেরের মধ্যে এম ডি অসীম নামের এক যুবক যোগ হয়েছেন। তাঁর বাড়ি খুলনায়। বিবাহবার্ষিকীতে তিনি তাঁর স্ত্রী ইসরাত টুম্পাকে হাউস করে চাঁদে জমি কিনে দিয়েছেন। তিনি জমিটা কিনেছেন অনলাইনে, লুনারএমব্যাসি ডটকম নামের একটা কোম্পানি থেকে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের নাম ডেনিস হোপ। তাঁর বাড়ি আমেরিকায়। অসীমের জমির দাম পড়েছে ৪৫ ডলার। এর আগে সাতক্ষীরার দুই তরুণ এস এম শাহীন আলম এবং শেখ শাকিল হোসেনও একই কোম্পানি থেকে জমি কিনেছেন। এই তিনজনের কাছেই ‘চাঁদের মালিক’ ডেনিস হোপ বিক্রয় চুক্তিনামা, কেনা জমির স্যাটেলাইট ছবি, দাগ নম্বর, মৌজা-পর্চাসহ সব কাগজপত্র ‘মিউটেশন’সহ পাঠিয়ে দিয়েছেন।

এ পর্যন্ত ৬০ লাখের বেশি লোকের কাছে চাঁদের ৬১.১ কোটি একর জমি বিক্রি করেছেন হোপ। একেক এরিয়ার জমির দাম একেক রকম। সবচেয়ে কম দামি জমি একরপ্রতি ২৪.৯৯ ডলার। সবচেয়ে দামি জমি একরপ্রতি ৫০০ ডলার।
ডেনিস হোপ যিনি ৪১ বছর ধরে চাঁদের জমি বিক্রি করছেন।

অসীমের স্ত্রী ইসরাত টুম্পা জমির দলিল পেয়ে বিরাট খুশি। তিনি বলেছেন, দলিল পেয়ে তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি চাঁদে চলে গেছেন। এই নিয়ে খবরের কাগজ ও টেলিভিশনে খবর বেরিয়েছে। বিস্তর ঠাট্টা-মশকরা হচ্ছে ফেসবুকে। কিন্তু ৪০ বছর ধরে এসব ঠাট্টা গায়েই মাখাননি ‘জমির মালিক’ ডেনিস হোপ। তিনি এই-সেই করে চার দশক ধরে সিরিয়াসলি চাঁদের জমি বেচে যাচ্ছেন। সারা দুনিয়ার বদন খুড়ারা জমি কিনছেন। তাঁদের হাতে দলিলের সঙ্গে একটি করে চাঁদের মানচিত্র ধরিয়ে দেন হোপ। তাতে তাঁরা বুঝতে পারেন, ঠিক কোন জায়গার জমিটা তাঁরা কিনলেন।

এ পর্যন্ত ৬০ লাখের বেশি লোকের কাছে চাঁদের ৬১.১ কোটি একর জমি বিক্রি করেছেন হোপ। একেক এরিয়ার জমির দাম একেক রকম। সবচেয়ে কম দামি জমি একরপ্রতি ২৪.৯৯ ডলার। সবচেয়ে দামি জমি একরপ্রতি ৫০০ ডলার। হোপ জানিয়েছেন, চাঁদের সবচেয়ে বৃহদাকৃতি জমির অংশটিতে ৫৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৪০ একর জায়গা আছে। সেই জায়গা কেনার মতো একটা ভালো ‘পার্টি’ খুঁজছেন তিনি।
হোপের সংস্থার নাম লুনার এমব্যাসি। হোপ নিজেই তার সিইও। এই সিইও-র মানে কিন্তু ‘চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার’ নয়, এর অর্থ হলো ‘সেলেশ্চিয়াল এক্সিকিউটিভ অফিসার’ তথা ‘মহাজাগতিক নির্বাহী কর্মকর্তা’।

ডেনিস হোপের দেওয়া চাঁদের জমির বিক্রয় চুক্তির দলিল

জাতিসংঘ ১৯৬৭ সালে বলেছিল, কোনো রাষ্ট্র ভিন্ন গ্রহ–উপগ্রহের মালিক হতে পারবে না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি এই দাবি করতে পারবেন না, এমন কথাও বলা নেই। সেই যুক্তিতে হোপ চাঁদের মালিকানা দাবি করে জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ তার জবাব দেয়নি। জাতিসংঘের মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে তিনি চাঁদের জমি বেচা শুরু করেছিলেন। ১৯৮০ সাল থেকে এই ৪১ বছর ধরে চলছে হোপের চাঁদের জমির ব্যবসা।

হোপ আর তাঁর কাস্টমারদের কেনাবেচা নিয়ে লোকে আগে হাসাহাসি করত। কিন্তু এখন হোপের দাবি অনেককেই ভাবাচ্ছে। আইনজ্ঞরা এখন বলছেন, এইভাবে চাঁদের জমি বিক্রি বৈধ না। কারণ, সরকার ছাড়া জমি বেচা যায় না। এরপর হোপ নিজেই চাঁদের নামে সরকার গড়েছেন। সেই সরকারের নাম গ্যালাকটিক ইনডিপেনডেন্ট গভর্নমেন্ট। তিনি নিজে সেই সরকারের প্রেসিডেন্ট।

২০০৯ সালে হোপের সরকারের স্বীকৃতিপত্রে সই করেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। সরকার থাকলে সংবিধান লাগে, দরকার নিজস্ব মুদ্রা, পতাকা, প্রতীকসহ আরও অনেক কিছু। হোপ সেই সবই বানিয়েছেন। তাঁর সরকারের নিজস্ব মুদ্রা আছে। নিজের আইনকানুনও আছে। নেভাদায় লুনার এমব্যাসির মূল কার্যালয়। সব মিলিয়ে ডজনখানেক কর্মী কাজ করেন সেখানে। আরও মারাত্মক কথা হলো, হোপ শুধু চাঁদে থেমে নেই। এখন তিনি বুধ, মঙ্গল, শুক্র, প্লুটো গ্রহের জমিও বেচা শুরু করেছেন।

চাঁদের ‘জমি’

হোপের এই মহাজাগতিক তেজারতির পুরোটাই কি ধাপ্পাবাজি? একটা ধাপ্পাবাজি এইভাবে চার যুগ ধরে চলতে পারে? বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ভংচং বুঝিয়ে তাদের পকেটের পয়সা এত সহজেই নিয়ে আসা যায়?

না। যায় না। আসলে ডেনিস হোপ নামের ওই মার্কিন ভদ্রলোক অত্যন্ত প্রতিভাধর একজন বিপণনশিল্পী। তিনি খদ্দেরদের সঙ্গে আগাগোড়া সততার সঙ্গে এক ইল্যুশনের ব্যবসা করে আসছেন। তিনি একবারও তাঁর কাস্টমারকে ফটিকলালের মতো বলেননি, ‘চাঁদে যাওয়ার জন্য ডবল ডেকার বাঁশের ব্যবস্থা আছে।’ তিনি শুধু কাস্টমারকে একটা ধারণা দিয়ে গেছেন। একধরনের জাদুবাস্তবতা মাখা কল্পনা তিনি দলিল-পরচার মতো স্পর্শযোগ্য বস্তুর মধ্য দিয়ে ফেরি করে আসছেন। তিনি কী বিক্রি করছেন, তা যেমন তিনি জানেন, তাঁর খদ্দেররা কী কিনছেন, তা–ও তাঁরা জানেন। এর মধ্যে ইভ্যালি, ই–অরেঞ্জ টাইপের অসততা নেই। কেনাবেচার পুরো প্রক্রিয়াটি হয় স্বচ্ছতা ও সততার মধ্য দিয়ে। সেই সততার টেলিস্কোপে চোখ রেখে খদ্দের যখন কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদে চোখ রাখে, তখন চাঁদের জমিকে তাঁর নিজেরই জমি মনে হয়। তাঁর চোখে চাঁদের বুড়ির বয়েস ষোলোতে নেমে আসে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com