যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে অংশগ্রহণের পর দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার অগ্রগতির ব্যাপারটি উত্থাপন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবর্ষ এ বছর। এ প্রেক্ষাপটে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে, গবেষণার বরাদ্দ বাড়িয়ে, বিদেশি শিক্ষক ও গবেষক নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালটিকে বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় কি না? এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সব সময়ই শিক্ষক এবং ছাত্রদের গবেষণা ও প্রকাশনার ব্যাপারে উৎসাহিত করে থাকেন। গবেষণার জন্য প্রাইমিনিস্টার’স এডুকেশন ফান্ড, বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট ফান্ড ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ফান্ডসহ আরও বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশে গবেষণার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুও অনেক জোর দিয়েছিলেন এবং নানা ধরনের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক বেশি গবেষণা হওয়া দরকার। ভবিষ্যতে বড় প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
গবেষণার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রবল আগ্রহ এবং গবেষণা সম্প্রসারণের জন্য তাঁর গৃহীত উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। তিনি উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পড়াশোনার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ’এবং চার বছরমেয়াদি ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ চালু করেছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে গবেষণা সরঞ্জাম ও বরাদ্দের অভাবে সেই গবেষণা বিকশিত করার সুযোগ থাকে না। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য তিনি ‘শেখ হাসিনা ফেলোশিপ’ চালু করেছেন। এ ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজমান।
গবেষণা বিকশিত করার জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে গবেষণা বরাদ্দ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সিঙ্গাপুরের প্রথম সারিতে থাকা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর (এনইউএস) এবং নানাং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি (এনটিইউ) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১৫-এর মধ্যে রয়েছে। ২০১৯ সালে এনইউএসের গবেষণা বরাদ্দ ছিল ৭৮১ মিলিয়ন ডলার। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) যৌথ গবেষণার নাম সিঙ্গাপুর এমআইটি অ্যালায়েন্স (এসএমএ)। এর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাৎসরিক পাঁচ মিলিয়ন ডলার। আমার বর্তমান কর্মস্থল কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের গবেষণার বরাদ্দ ছিল প্রায় ৯২ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত গবেষণার জন্য রাখা হয় প্রায় ২২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজ্ঞান গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় ৫৭ মিলিয়ন ডলার।
কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কার্বন নিউট্রাল এনার্জি রিসার্চ-এর অন্তর্গত আমার ল্যাবরেটরিটি। এটি স্থাপিত হয় ২০১০ সালে। প্রতিষ্ঠার পর ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ মিলিয়ন ডলার। প্রায় ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয় ইউনিভার্সিটি অব ইলিনোয়িস আরবানা-ক্যাম্পেইন (ইউআইইউসি)-তে একটি স্যাটেলাইট গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনার জন্য। বর্তমানে জাপানে সাতটি ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার ইন্টারন্যাশনাল (ডাব্লিউপিআই) প্রজেক্ট চালু আছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু একক গবেষণাতেই অর্থ বাড়ায়নি বরং পাশাপাশি বরাদ্দ বাড়িয়েছে সম্মিলিত গবেষণাতে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, যুগোপযোগী গবেষণা করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হওয়া। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ সালে প্রস্তাবিত গবেষণা বরাদ্দের পরিমাণ হলো মাত্র ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার। এই সামান্য অর্থ দিয়ে মানসম্মত গবেষণা অথবা সম্মিলিত গবেষণা করা একেবারেই সম্ভব নয়। তাহলে করণীয় কী?
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সেটা অনুমোদন দিয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যানটি শিগগিরই সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এতে প্রযুক্তিগত ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিশ্বমানের গ্রন্থাগার স্থাপন, সবুজায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পয়োনিষ্কাশন, আধুনিক ব্যায়ামাগার নির্মাণ, মানসম্মত চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে আমাদের গবেষণা বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে এনার্জি গবেষণা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, বিগ ডেটা, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স—এসব সেক্টরে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে। নিয়মিত গবেষণা পর্যবেক্ষণ এবং ফলাফল নিরীক্ষণ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সফল গবেষণাগুলো পেটেন্ট করতে হবে। আগামী দশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। প্রথম তিন-চার বছরে হয়তো কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়বে না, কিন্তু এরপর থেকে আশানুরূপ ফলাফল আসতে শুরু হবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সেটা অনুমোদন দিয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যানটি শিগগিরই সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এতে প্রযুক্তিগত ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিশ্বমানের গ্রন্থাগার স্থাপন, সবুজায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পয়োনিষ্কাশন, আধুনিক ব্যায়ামাগার নির্মাণ, মানসম্মত চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আধুনিক গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন, নতুন ল্যাবরেটরি নির্মাণ ও বিদ্যমান ল্যাবরেটরির বরাদ্দ বাড়ানো, বিশিষ্ট বিদেশি গবেষক এনে দেশি গবেষণার উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এই মাস্টারপ্ল্যানে উপেক্ষিত হয়েছে।
বর্তমানে মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলো বিদেশি প্রকৌশলী এনে পরিচালনা করা হয়। কিন্তু এসব বড় প্রকল্পে গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করা হলে, ভবিষ্যতে নিজেদের প্রকৌশলীরাই সবকিছু পরিচালনা করতে পারবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে মেগা প্রকল্প করতে হবে, বিশ্বমানের গবেষকদের এনে উচ্চমানের গবেষণা দেশেই করার ব্যবস্থা করতে হবে।
জাপানের অবস্থা শুরুতে এমন ছিল না। দেশটি সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিনিয়োগ শুরু করে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাইকার প্রধান শিনিচি কিতাওকা টোকিওতে একটি ‘অভিজ্ঞতা ও মতবিনিময়’ সভায় অংশগ্রহণ করেন। তরুণ প্রজন্মকে সুদক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জাইকার প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। শিনিচি কিতাওকা এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক বছরের। এ ধরনের একটি কেন্দ্র স্থাপিত হলে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।
বিদ্যুৎ বরণ সাহা অধ্যাপক এবং প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কার্বন নিউট্রাল এনার্জি রিসার্চ, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।