মহামারির কারণে নির্ধারিত দিন-তারিখে (১০ ফেব্রুয়ারি) শুরু হয়নি চট্টগ্রামের অমর একুশে বইমেলা। এ বছর আদৌ এ মেলা হবে কি না, এ নিয়ে সংশয় ছিল লেখক-প্রকাশকদের মনে। কিন্তু সময় পিছিয়ে বাংলা একাডেমি ১৮ মার্চ থেকে ঢাকায় মাসব্যাপী বইমেলার আয়োজন করলে, সংগতি রেখে চট্টগ্রামেও ২৩ মার্চ থেকে মেলা করার সিদ্ধান্ত হয়।
চট্টগ্রামে এ মেলার পৃষ্ঠপোষক সিটি করপোরেশন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এর সাফল্য নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের মেয়র, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, লেখক-সাংস্কৃতিক কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে নিয়মিত সংবাদ ও বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১২৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করে। স্টল বরাদ্দের জন্য নির্ধারিত মূল্যও তারা পরিশোধ করেছে।
ঢাকার অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সদ্য প্রকাশিত বইপত্রও পাঠিয়ে দিয়েছে, প্রথম দিন থেকেই যাতে মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রয় সম্ভব হয়। মোটকথা, স্টলসজ্জাসহ বইমেলার যাবতীয় প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। ঠিক এ সময় হঠাৎ করে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হলো ২৭ ও ২৮ মার্চ বইমেলার জন্য নির্ধারিত স্থান জিমনেসিয়াম চত্বরে উন্নয়ন মেলা হবে। শুনে প্রকাশকদের মাথায় হাত, উদ্বিগ্ন লেখক ও পাঠককুল। তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে। নানাভাবে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, মাত্র দুদিনের উন্নয়ন মেলার জন্য প্রায় ২০ দিনের বইমেলার সময়সূচি পরিবর্তন করা যুক্তিসংগত হবে না।
তা ছাড়া মহামারি পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় যেকোনো সময় জনসমাগম এড়াতে বইমেলা সীমিত বা স্থগিত করার ঘোষণা আসতে পারে। অর্থাৎ নির্ধারিত দিনে শুরু করতে না পারলে এ বছর বইমেলা আদৌ হবে কি না, সেই শঙ্কা ও সংশয় থেকে যাচ্ছে। দুদিনের উন্নয়ন মেলা করার মতো স্থানের অভাব যে চট্টগ্রামে নেই, এ কথাও জেলা প্রশাসককে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন লেখক-প্রকাশক-সংস্কৃতিকর্মীরা। কিন্তু তিনি কর্ণপাত করেননি। বইমেলার নির্ধারিত স্থানেই উন্নয়ন মেলা করতে তিনি বদ্ধপরিকর। তাতে কার কী অসুবিধা, তা বিবেচনার দায় কাঁধে নিতে রাজি নন তিনি।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সচিব জামাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমরা স্টেডিয়ামের ভেতর, আউটার স্টেডিয়াম, পলোগ্রাউন্ড মাঠ, এমনকি জিমনেসিয়ামের ভেতর উন্নয়ন মেলা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু বইমেলার স্থানেই উন্নয়ন মেলা করতে চায় জেলা প্রশাসন। ওনারা বারবার বলছেন জিমনেসিয়াম মাঠ সরকারি জায়গা। এখন আমাদের প্রশ্ন, আমরা কি সরকারের জনগণ নই?’
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছেন বইমেলার আয়োজকেরা। এখন অনিশ্চয়তার নানা দোলাচল নিয়ে ২৯ মার্চ থেকে মেলা শুরু করার পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। বইমেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক নগরের সদ্য নির্বাচিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। কিন্তু মেলা নিয়ে এ টানাপোড়েনে তাঁর কোনো ভূমিকাই যেন নেই। একজন সরকারি আমলার একগুঁয়েমির কাছে একজন জনপ্রতিনিধির অসহায়ত্ব প্রত্যক্ষ করার সুযোগও আমাদের হলো!
ডিসি সাহেবদের দাপটের সঙ্গে পরিচয় অবশ্য আমাদের নতুন নয়। এর আগে একজন জেলা প্রশাসক চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্র ডিসি হিল প্রাঙ্গণে বছরে দুই দিন (পয়লা বৈশাখ ও রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী) ছাড়া সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছেন। একই প্রাঙ্গণে সকাল ও সান্ধ্য ভ্রমণকারীদের চলাচলও সীমিত করা হয়েছে। কেন? কারণ, এতে ডিসি সাহেবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হয়, এমনকি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ‘শব্দদূষণে’ তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ডিসি হিলের পরিবর্তে নগরের যেকোনো একটি জায়গা বরাদ্দের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন একজন ডিসি। সংস্কৃতিকর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এই সরকারি কর্মকর্তাকে কে বোঝাবে ওই পাহাড়ের চূড়া থেকে জেলা প্রশাসকের বাসভবনটি স্থানান্তর করলে তাঁর নিজের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন ঘুম যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির ঐতিহ্যও রক্ষা পায়।
একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র একদিনে গড়ে ওঠে না। জেলা প্রশাসকের বরাদ্দের ওপর ভিত্তি করে রাতারাতি সংস্কৃতিমুখর প্রাঙ্গণ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। হলে ঢাকার রমনার বটমূল, টিএসসি চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানের নাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত না।
একসময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন মতিউল ইসলাম, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোজাম্মেল হক, হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো উচ্চশিক্ষিত (একাডেমিক অর্থে নয়) ও সংস্কৃতিমান ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন তো পাকিস্তান আমলে প্রতিকূল পরিবেশেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ দেশে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ যখন গর্হিত অপরাধ, সেই ষাটের দশকে রবীন্দ্রজয়ন্তীর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তৎকালীন ডিসি সাহেবেরা।
হাসনাত আবদুল হাই শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ নামের সংগঠন গড়ে ‘চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক উৎসবে’র আয়োজন করেছিলেন। অসাধারণ এই উৎসবের কথা এখনো স্মরণ করেন নগরের প্রবীণ সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এই হাসনাত আবদুল হাইয়ের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি।
সরকারি চাকরিতে বদলি নিয়মিত একটি ঘটনা। কেউ একই পদে চিরকাল থাকবেন না। কিন্তু বর্তমানের ক্ষমতাবানেরা হয়তো এ কথা ভাবেন না, ভবিষ্যৎ তাঁদেরই স্মরণে রাখে, অতীতে যাঁরা মানুষের পাশে ছিলেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, চট্টগ্রামের বইমেলা সুশৃঙ্খল রূপ পেয়েছে গত দুই বছরে। এর আগে কখনো মুসলিম ইনস্টিটিউট চত্বরে, কখনো ডিসি হিল প্রাঙ্গণ বা লালদীঘির ময়দানে একই সময়ে একাধিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। চট্টগ্রামের লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের দাবি মেনে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন একটি অভিন্ন স্থানে অভিন্ন বইমেলা করার উদ্যোগ নেন। তাতে ঢাকার পরে এ মেলাই দেশের সবচেয়ে গোছানো বইমেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবছর ১০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি বইমেলাটি অনুষ্ঠিত হবে, এমন সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছিলেন নাছির।
যা হোক, নানা দ্বিধা-সংশয়ের মধ্যে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের মর্জিমাফিক ২৯ মার্চ থেকে বইমেলা শুরু হতে যাচ্ছে। এ মেলা লেখক-পাঠক-প্রকাশকের অংশগ্রহণে সফল হয়ে উঠুক, এ কামনা করি। তবে একজন সরকারি আমলার জেদের কারণে বইমেলার মতো একটি সর্বজনীন উৎসবের সময়সূচি পরিবর্তনের এ ঘটনা বাজে দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
bishwabd@yahoo.com