চট্টগ্রামের নালাগুলো কেন এমন ‘মৃত্যুকূপ’ হলো?

শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া
শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া

শৈশবে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহরে থিতু হতে এসে আমরা যে নতুন মাইকিং শুনলাম—একটি নিখোঁজ সংবাদ...আজ বেলা এত ঘটিকায় অত্র এলাকা থেকে একটি শিশু হারিয়ে গিয়েছে...। এর আগে মাইকিং বলতে আমরা বুঝতাম নির্বাচন বা ওয়াজের প্রচারণা। নব্বই দশকে ছেলেদের নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে এসে এমন মাইকিং শুনে আমাদের মায়ের ভেতরেও নতুন আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছিল, সেটি হলো ‘ছেলেধরা আতঙ্ক’, কারণ প্রতিদিনই এমন কোনো মাইকিং শোনা যেত। ফলে আমাদের অহেতুক বাইরে যাওয়া নিয়েও সতর্ক থাকতে হতো তাঁকে।

গত দুই যুগে সেই চট্টগ্রাম অনেক বদলে গেছে, ছেলেধরাদের নিয়ে সে ভয়ও নেই। কিন্তু এখন নতুন যে আতঙ্ক হাজির হয়েছে, নালার মধ্যে পড়ে হারিয়ে যেতে পারে সন্তান। ভাগ্যক্রমে লাশটা খুঁজে পেলেও বর্জ্য-আবর্জনা ও পয়োনালার পানিতে কদাকার লাল টুকটুকে সোনার মুখ। গত সোমবার সারা রাত ধরে যুদ্ধ করে উদ্ধার হওয়া শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার লাশটাও নিশ্চয়ই এমনই ছিল।

সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পা রেখেছিলেন পরির মতো সুন্দর মেয়েটি, কিন্তু নানা ও মামার সঙ্গে চোখের চিকিৎসক দেখাতে গিয়েছিলেন। নতুন চশমার পাওয়ার আনন্দে হয়তো রাস্তায় পা রাখতে বেখেয়াল হয়ে পড়েছিলেন, সেটিই কাল হয়ে দাঁড়াল তাঁর জন্য। তাই বলে লাশ হয়ে যেতে হবে তাঁকে। শৈশবের কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম, সে সময় বেখেয়ালে চলতে গিয়ে নালার মধ্যে পড়ে আমার হাত-পা ছিলে গিয়েছিল। রাস্তায় চলতে–ফিরতে স্বাভাবিকভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু নালায় পড়ে গিয়ে এভাবে লাশ হয়ে ফিরতে হবে মায়ের কোলে? নানার হাত ধরেই তো হাঁটছিলেন তিনি। তাঁর তো কোনো অসর্তকতা ছিল না।

করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলতে যাচ্ছে, তারুণ্যে পা রাখা যে মেয়েটি অপেক্ষা করছিল ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার, বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাসে বিভোর হওয়ার, তাঁর সবকিছুই এভাবে হারিয়ে গেল নালার পূতিগন্ধময় অন্ধকারে!

এমন মৃত্যু কে কামনা করে, কেউ কি ভাবতে পারে? সন্তানের শোকে বোবা হয়ে থাকা সাদিয়ার মা নিজেকে কোন সান্ত্বনা দেবেন। যে মামা ভাগনির খোঁজে সঙ্গে সঙ্গে নালায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁর যন্ত্রণা বোঝার কোনো উপায় আছে কী?

‘বাণিজ্যিক নগরী’ বা ‘বন্দরনগরী’—এমন গালভরা উপাধি নিয়েও বরাবরের মতোই অবহেলিত ছিল চট্টগ্রাম। এরপর একের পর এক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে আশায় বুক বেঁধেছিল নগরবাসী। কিন্তু দশক পার হয়ে যায়, সেসব উন্নয়নের সুফল পাওয়া যায় না।

প্রথম আলোর ভিডিও প্রতিবেদনে দেখলাম, আরবি ক্যালিগ্রাফিতে দারুণ হাত ছিল সাদিয়ার। সেগুলো বাঁধাই করেও রেখেছেন বাসায়। সেই ক্যালিগ্রাফি বুকে চেপে ধরে মায়ের কান্নার আওয়াজ কীভাবে সওয়া যায়। তা–ও তাঁকে ‘ভাগ্যবানই’ বলতে হবে, মেয়ের লাশটা অন্তত পেয়েছেন। আরেক মা এখনো সন্তানের লাশটাও ফিরে না পেয়ে ঘুমের ঘোরে ‘অ পুত, অ পুত’, বলে কান্না করেন। এক মাস পার হয়ে গেল, ফলবিক্রেতা ছেলে ছালেহ আহমেদের খুঁজে পাওয়া গেল না। নালায় পড়ে ‘গায়েব’ হয়ে গেলেন তিনি। সবাই তাঁর কথা ভুলে গেলেও বৃদ্ধ মা কীভাবে ভোলেন সেই শোক। লাশটা অন্তত পাওয়া গেলে হয়তো নিজেকে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারতেন।

নিখোঁজ ছালেহ আহমেদ বাংলা সিনেমার মতো কোনো একদিন হাজির হবেন, এমন আশা ব্যক্ত করতে গেলেই পাঠক ক্ষিপ্ত হবেন। তাঁকে যে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেটিই এখন নিষ্ঠুর বাস্তবতা। কিন্তু একটা মানুষের মৃতদেহ খুঁজে না পেয়ে থাকলে, সেটি পচে–গলেও তো গন্ধ বের হওয়ার কথা কোথায় না কোথাও। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাহীন এত বড় একটা শহরের নালাগুলো এমন আবর্জনার ভাগাড় হয়ে গেছে, একটা পচাগলা লাশকে পর্যন্ত হজম করে ফেলল!

নগরে জলাবদ্ধতার সময় গত ছয় বছরে নালা-নর্দমা ও খালে পড়ে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। সাদিয়াসহ গত তিন মাসেই প্রাণ গেল চারজনের। কিন্তু বারবার কেন এ ঘটনা ঘটছে? চট্টগ্রামের নালাগুলো কেন এমন মৃত্যুকূপ হয়ে উঠল? একটি প্রকল্প শেষে কিছুদিন যেতে না যেতেই সেটিকে খুঁড়ে ফেলা হচ্ছে আরেকটি প্রকল্পে। প্রকল্পের চক্করে পড়ে শহরের কোনো সড়কই বেশি দিন ঠিকঠাক থাকে না, হাঁটার রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না, নালা-নর্দমাগুলো বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে থাকে বছরের পর বছর। প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটতে গিয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না।

অথচ নালাগুলোতে নিরাপত্তাবেষ্টনী দেবে, এমন দায়িত্ব কেউ নেয় না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বা ওয়াসা নগর দেখভালের প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়ে যায়। আরও হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, ভালো সড়কগুলোকেই সংস্কারের নামে দুই শতাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। যে রাস্তাগুলো নতুন ও চকচকে সেগুলোর কিসের আবার সংস্কার, এটা তো বরাদ্দ লোপাটেরই সরাসরি প্রচেষ্টা।

‘বাণিজ্যিক নগরী’ বা ‘বন্দরনগরী’—এমন গালভরা উপাধি নিয়েও বরাবরের মতোই অবহেলিত ছিল চট্টগ্রাম। এরপর একের পর এক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে আশায় বুক বেঁধেছিল নগরবাসী। কিন্তু দশক পার হয়ে যায়, সেসব উন্নয়নের সুফল পাওয়া যায় না। বিতর্কিতভাবে একের পর এক উড়লসড়ক বানিয়ে ফেলা হয় শত শত কোটি টাকা দিয়ে, একের পর এক পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা ও সড়ক নির্মাণ করা হয়, জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল কি, উড়ালসড়কের ওপর পর্যন্ত জলজট হয়ে থাকে, টানা কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি পড়লে প্রায় গোটা নগরই ডুবে যায়।

যে বন্দরের রাজস্ব দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে, সেই বন্দর অভিমুখী রাস্তা দিয়ে কোনো অন্তঃসত্ত্বাকে হাসপাতালে নিতে গেলে পথিমধ্যেই সন্তান প্রসব হওয়াই যেন নিয়তি। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার প্রধান সড়কের অবস্থা দেখলে যে কেউ চট্টগ্রামের এমন দুর্গতির জন্য আফসোসই করবেন।

ভাবতেই অবাক লাগে, ব্রিটিশবিরোধী দুঃসাহসী অবদানের জন্য যে শহরকে ‘বীর চট্টলা’ বলা হয়, তার দেখভালের জন্য প্রকৃত কোনো অভিভাবক নেই! বীর চট্টলার নাগরিকেরা এভাবে নালায় পড়ে মরছে। এত এত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা সিটি মেয়র বা সিডিএর চেয়ারম্যান হলেন, কেউই জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করতে পারলেন না।

ভাবতেই অবাক লাগে, ব্রিটিশবিরোধী দুঃসাহসী অবদানের জন্য যে শহরকে ‘বীর চট্টলা’ বলা হয়, তার দেখভালের জন্য প্রকৃত কোনো অভিভাবক নেই। বীর চট্টলার নাগরিকেরা এভাবে নালায় পড়ে মরছে। এত এত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা সিটি মেয়র বা সিডিএর চেয়ারম্যান হলেন, কেউই জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করতে পারলেন না। তাঁদের চোখের সামনে একের পর এক পাহাড় হারিয়ে গেল সবুজ প্রকৃতিকন্যা নগরীটি থেকে। পাহাড় ধ্বংস করে জলাবদ্ধতা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলা হলো। এখন ‘সবেধন নীলমণি’ মনে হয়ে টিকে থাকা সিআরবি ও টাইগার পাসের ওপরেও চোখ পড়েছে। সেগুলো খুবলে খেতেই এখন সবাই উঠেপড়ে লেগেছে।

‘চট্টগ্রামের মাটি, অমুক ভাইয়ের ঘাঁটি’, স্লোগান বা দেয়ালিকা তো এখনো শোনা বা দেখা যায়। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে বিশাল বিশাল বিলবোর্ড ও ডিজিটাল ব্যানারে নানা উন্নয়নের ফিরিস্তি। সেসব ‘উন্নয়ন-শার্দূলদের’ বিশাল ছবিসহ চট্টগ্রামকে ‘সিঙ্গাপুর’ আখ্যা দেওয়া ব্যানার যখন পানির নিচে তলিয়ে যায়, সামান্য বৃষ্টিতে মেয়রের নিজের বাসভবনই যখন ডুবে যায়, লজ্জা লাগে না তাঁদের? কোনো অনুশোচনা বোধ কিংবা সামান্য অনুভূতি কি হয় না তাঁদের?

পাঠক এমন প্রশ্নে নিশ্চয় হাসবেন। কারণ, লজ্জা থাকলে তো ছালেহ আহমেদের ৮০ বছর বয়সী মায়ের কাছে গিয়ে তাঁরা ক্ষমা চাইতেন। অনুশোচনা বোধ থাকলে তো সাদিয়ার পরিবারের কাছে ছুটে যেতেন সহানুভূতি নিয়ে। কিন্তু যেভাবে তাঁরা নির্বাচিত হন, দায়িত্ব পান, তাতে তাঁদের কাছে এসব আশা করাই সম্ভবত ভুল! সেসব নির্বাচনের আগে ঢাকা থেকে ‘ভাড়া’ করে নিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র তারকাকে দিয়ে আবার চট্টগ্রামের রাস্তাকে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করানো হয়। সেই ‘ইউরোপের রাস্তা’ এখন অনেক মায়ের কাছে ‘ছেলেধরা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরের ‘জল নিষ্কাশনব্যবস্থা’ উন্নয়নে ১৬৫ বছর আগে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, এরপর দুইবার মানচিত্র বদলে গেল দেশের, কিন্তু বদলাল না চট্টগ্রামের ভাগ্য।দুর্ভাগ্যতা হচ্ছে, বীর চট্টলার মানুষও সেই ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। ফলে দেশ এখন ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভাসলেও চট্টগ্রাম আটকে আছে জলাবদ্ধতায়, যার বদৌলতে এলাকায় এলাকায় ‘মৃত্যুকূপ’ দেখতে পাচ্ছি। যেগুলো একের পর এক টেনে নিচ্ছে তরতাজা মানুষকে। ছালেহ আহমেদ গেলেন, সাদিয়া গেলেন, এরপর কে?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক