মতামত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিটের আলাদা পরীক্ষা বাতিলের খামখেয়াল কেন

ঢাকা বিশ্ববিদালয় ভর্তি পরীক্ষা থেকে ‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিটকে বাদ দেওয়ার আলোচনা চলছে।
প্রথম আলো

এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা চলছিল অনেক দিন ধরেই। তবে এত দিন নানা কারণে সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এবার সিদ্ধান্তটি কিছুটা পাকাপাকিই করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদালয় ভর্তি পরীক্ষা থেকে ‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিটকে বাদ দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বছর থেকে ঢাবির ‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হবে না। এ ক্ষেত্রে কলা অনুষদভুক্ত ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সম্ভবত এই ইউনিটের সঙ্গেই যুক্ত করা হবে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে।

কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত? যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ‘ঘ’ ইউনিট বাতিল হলেও ‘ক’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েও কেউ বিভাগ পরিবর্তন করতে পারবেন। নিশ্চয়ই তা পারবেন। কিন্তু আমি জানতে চাই, একজন শিক্ষার্থীকে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে হলেও কেন ‘ক’ কিংবা ‘খ’ ইউনিটেই শুধু পরীক্ষা দিতে হবে? কিংবা রসায়ন, পদার্থ, গণিতে পাস করেই তাঁকে কেন সামাজিক অনুষদভুক্ত বিভাগে যেতে হবে হবে? এগুলো কোনোভাবেই মাথায় ঢুকছে না। কেন তাঁকে তাঁর আগ্রহ এবং সেই বিষয়ে তাঁর দখল এবং জানাশোনা পরখ করার সুযোগ দেওয়া হবে না? বরং গত বছর থেকে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, চিন্তাকে সম্মান জানিয়ে এবং তাঁদের যোগ্যতা আরও বৈচিত্র্যে যাচাই করার জন্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এমসিকিউয়ের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, জানাশোনা এবং অনুবাদ সক্ষমতা মূল্যায়নের জন্য আলাদাভাবে প্রশ্ন রেখেছিল।

বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কলেজজীবন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাঁদের পছন্দমতো বিষয় এবং গ্রুপ নির্বাচনের সুযোগ পান না। সে ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় সন্তানকে নিয়ে মা–বাবার স্বপ্ন, যেখানে এখন পর্যন্ত বেশি গুরুত্ব পায় ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। যে কারণে বেশির ভাগ মা–বাবার সন্তানদের বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে উৎসাহিত করেন কিংবা জোর করেন। সন্তানদের পছন্দকে খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কলেজজীবনের পরে শিক্ষার্থীরা তাঁদের মতো করেই বিষয় বাছাই করার ক্ষমতা অর্জন করেন। সে ক্ষেত্রে আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড বিজ্ঞানের হলেও তাঁদের আগ্রহ ছিল সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়াবলি। যার কারণে তাঁরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন শুধু সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটেই।

জানা গেছে, প্রশাসন নাকি পরীক্ষার সংখ্যা এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানোই মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা কোথায়? গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে। তাহলে কেন সেটি বন্ধ হবে? দুই অনুষদের পরীক্ষার দিন কমিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানোর চিন্তা মোটেও যে শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে নয়, সেটির উদ্দেশ্য যে অন্য জায়গায় এবং তা যে শিক্ষকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

এবার আসি ‘চ’ ইউনিট বিষয়ে। এই ইউনিটটি একটি বিশেষায়িত ইউনিট। অর্থাৎ চারুকলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোকে নিয়ে এই ইউনিট। এই ইউনিটে পরীক্ষার্থী সবচেয়ে কম থাকে। চারুকলায় ভর্তিপ্রক্রিয়া সেই অনুষদকে বাদে কীভাবে অন্যরা যাচাই করবেন, সেটিও বোঝা কঠিন। এখানে শুধু পরীক্ষায় পাসের বেলাতেই নয়, ভাইভাতেও নম্বর থাকে, যা অন্য অনুষদে থাকে না। তাহলে কীভাবে এই শিক্ষার্থীরা এই ক্ষেত্রে তাঁদের আগ্রহ এবং যোগ্যতা প্রমাণ করবেন? চারুকলার জন্য আলাদা পরীক্ষা না রেখে ‘খ’ ইউনিট থেকেই যদি চারুকলায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়, তাহলে একসময়ের ‘আর্ট কলেজ’–এর গ্ল্যামার নিয়ে থাকা চারুকলা তার নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে তো?

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদই তার কাছে সমগুরুত্ব পাওয়ার কথা। এর বিপরীতে গিয়ে কিছু অনুষদগুলোকে সংকুচিত করে অন্যগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করা বিশ্ববিদালয়ের ধারণার সঙ্গে একেবারেই যায় না।

সিদ্ধান্তটি এসেছে ডিনস কমিটি থেকে। কিন্তু এগুলো কি আসলেই শিক্ষকদের মতামত? নিশ্চিতভাবেই নয়। ডিনদেরও মনে রাখতে হবে, ওনারা অনুষদের শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ডিন। তাহলে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটি হতে হবে সেই অনুষদের সব কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত। তাহলে প্রশ্ন আসে, সংশ্লিষ্ট অনুষদের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা না করে কীভাবে ডিনরা ওনাদের ব্যক্তিগত মতামতকে সিদ্ধান্ত আকারে হাজির করলেন? এক অনুষদের কাছে আরেক অনুষদ কম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তাই বলে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষকের মতামতকে উপেক্ষা করে কোন ক্ষমতাবলে তাঁরা নিলেন? যদিও বলা হয়েছে, একাডেমিক কাউন্সিলে এটি চূড়ান্ত হবে। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেখানে যুক্তিতর্কের চেয়ে প্রাধান্য পায় ক্ষমতা, আনুগত্য এবং তোষামোদ। তাই শঙ্কাটি থেকেই গেল।

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বয়স পঞ্চাশ। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা হয়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছয় হাজেররও বেশি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যার প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। ১৬টি বিভাগ নিয়ে এই অনুষদ এবং বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, অসমতা, বৈষম্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসনসহ সবকিছুকে নিয়ে প্রতিনিয়তই কাজ করছে এবং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করছে। তাই এসব বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এই অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগও রয়েছে পুরোনো এবং দু–একটি বিভাগ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদই তার কাছে সমগুরুত্ব পাওয়ার কথা। এর বিপরীতে গিয়ে কিছু অনুষদগুলোকে সংকুচিত করে অন্যগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করা বিশ্ববিদালয়ের ধারণার সঙ্গে একেবারেই যায় না। তাই সামাজিক বিজ্ঞান ও চারুকলার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো অনুষদকে ভর্তি পরীক্ষার পরিসর থেকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রক্ষণশীল’ মনোভাবকেই সামনে আনছে। গোঁজামিল নয়, বরং এসব অনুষদের বিভাগগুলোর কাজ ও চিন্তার বৈচিত্র্যের ওপর ভিত্তি করেই সামাজিক বিজ্ঞান ও চারুকলা অনুষদের পরীক্ষা আলাদা নেওয়ার বিষয়টি বহাল রাখতে হবে। এই দুটো অনুষদকে কলা ও বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে নয়, তাদের নিজস্ব অনুষদেই সবকিছু পরিচালনা করতে দিতে হবে এবং এর মধ্য দিয়েই শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়টি বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তার পরিসরটি আরও মজবুত করবে।


জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদালয়।
zobaidanasreen@gmail.com