ঘূর্ণিঝড়ের পর যা করতে হবে

ড. আইনুন নিশাত। ছবি: প্রথম আলো
ড. আইনুন নিশাত। ছবি: প্রথম আলো

যখন লিখতে বসেছি তখনো ঘূর্ণিঝড় আম্পান সমুদ্রে অবস্থান করছে। বিকেল ৩-৪টা নাগাদ ভারতের দিঘার কাছাকাছি এলাকা দিয়ে ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করবে। এরপর হয়তো সেটি কলকাতা শহরের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা-যশোর অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে উত্তর দিকে রওনা দেবে।

কোনো কোনো পূর্বাভাসে দেখলাম, এটি রাজশাহীর দিক দিয়ে পরবর্তী সময়ে আসামে যেতে পারে। কোনো পূর্বাভাসে দেখলাম, একটু পূর্ব দিকে গিয়ে ঢাকার কাছাকাছি ময়মনসিংহ অতিক্রম করতে পারে। এর দিক ঘন-ঘন বদলাতে পারে। এ কারণে ২৪ ঘণ্টা আগে সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তবে বুধবার বিকেল ৫টা নাগাদ ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করলেও এর প্রভাব রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত প্রচণ্ড থাকবে।

আইলায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ আবারো ভাঙার উপক্রম হয়েছে। ৩ নং কয়রা লঞ্চঘাট এলাকা, কয়রা, খুলনা। ছবি : সাদ্দাম হোসেন

এখানেই একটি ভয়ের কথা আছে। কারণ অমাবস্যার সময় এটা। প্রাকৃতিকভাবেই জোয়ার-ভাটার মাত্রা এই সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। স্বাভাবিকের তুলনায় সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চলে ভরা কটালের প্রভাবে নদীর পানি ৭-১০ ফুট বেশি হতে পারে। এই ভরা কটালে যদি জলোচ্ছ্বাসটি আমাদের অংশে প্রবেশ করে, তাহলে ওই সব উপকূলীয় বাঁধগুলো উপচে ভেতরে পানি ঢোকার বিরাট আশঙ্কা রয়েছে। তবে এটি যেহেতু ভারতের সুন্দরবন ও আমাদের সুন্দরবনের অংশ দিয়ে ঢুকবে, সেহেতু জলোচ্ছ্বাসের শক্তি কিছু কম হতে পারে। তার পরও বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরই বলছে যে স্বাভাবিক অবস্থার জোয়ারের তুলনায় ৮-১০ ফুট বেশি জোয়ার হতে পারে।

এমনিতেই আমাদের উপকূলীয় বাঁধগুলো বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। আজকের কাগজে দেখলাম, আইলার পর কয়রা থানায় যেসব জায়গায় বাঁধ ভেঙে নোনা পানি ঢুকেছিল, সেগুলো জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। বহু জায়গায় অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় আছে। সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলের বহু জায়গায় নদীভাঙনের কারণে নদী একেবারে বাঁধের কিনারে চলে এসেছে। অনেক জায়গায় বাঁধের অর্ধেকের বেশি ভেঙে গেছে। কাজেই আম্পানের চাপে বহু জায়গায় বাঁধ ভাঙলে আমি বিস্মিত হব না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার কথা।

আমাদের উপকূলে বর্তমানে বাঁধের উচ্চতা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ১৫ ফুট, ভেতরের দিকে ১৪ কিংবা ১২ ফুট। এগুলো যদি সবল থাকে তাহলে ১৪-১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে দিতে পারবে, এই লক্ষ্যে আমাদের দেশে যে ১৩৯টি পোল্ডার আছে, এর মধ্যে ১০টি পোল্ডারের মেরামতের কাজ তথা উচ্চতা বাড়ানোর কাজ চলছে। তাহলে বাকি পোল্ডারগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে।

ঝড়ের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছে মানুষ। মঠবাড়ি, কয়রা উপজেলা , খুলনা। ছবি : সাদ্দাম হোসেন

যেহেতু আমি লিখছি জলোচ্ছ্বাসটি হওয়ার আগেই এবং যেহেতু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে পাচ্ছি জোয়ারের উচ্চতা ঠেকানোর মতো অবস্থায় বাঁধগুলো না–ও থাকতে পারে, তাহলে ভয় হচ্ছে বাঁধ ভেঙে নোনা পানি ভেতরে ঢুকবে। একবার নোনা পানি ঢুকে গেলে এটা যতক্ষণ ভেতরে অবস্থান করবে ততক্ষণ মাটিকে দূষিত ও লবণাক্ত করবে। আইলা কিংবা সিডরের পরে বাঁধ মেরামতে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। কোনো কোনো জায়গায় দু-তিন বছর লেগেছে বাঁধ মেরামত করতে এবং এই দুই-তিন বছর ধরে জোয়ারের পানি ঢুকে মানুষকে কল্পনাতীত দুরবস্থায় ফেলে দিয়েছে। জমিগুলো ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়েছে, ৪-৫ বছর কোনো ফসল হয়নি। এরপর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় লবণাক্ততা কমে যাওয়ায় কিছু কিছু ফসল হচ্ছে। এবার এই লবণাক্ততার মাত্রা এমন হবে, যেটাতে চিংড়ি–কাঁকড়া চাষ করা সম্ভব হবে কি না, আমার সন্দেহ থাকবে।

এমন অবস্থায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার বিনীত আবেদন, যেসব জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব মেরামত করতে হবে। উপকূলে পোল্ডারগুলোতে বহু জায়গাতে স্লুইসগেট আছে, বহুলাংশে এগুলো কাজ করে না। বহু জায়গাতে স্লুইসগেটের কপাট নেই। কাজেই শুধু বাঁধ মেরামত করলেই হবে না, এই স্লুইসগেটের কপাটগুলোও মেরামত করতে হবে। তার সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন, কৃষি বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিতে পারবেন কী করে দ্রুত জমিগুলোকে ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যায়। আমার একটি ধারণা আছে, বেড়িবাঁধের ভেতরে পাশ দিয়ে যদি ড্রেন বা পরিখার মতো করে কেটে দেওয়া যায়, তাহলে বৃষ্টির পানি জমিগুলোকে ধুয়ে লবণমুক্ত করতে পারবে। অর্থাৎ লিচিং প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে হবে, শুধু প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিলে হবে না।

একই সঙ্গে অনুমান করতে পারি, যেহেতু আম্পানের বাতাসের গতিবেগ সমুদ্রে থাকাকালে ১৮০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। হয়তো এটা বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় অনেক কমবে। তার পরও এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি থাকবে, এই আশঙ্কা আমি করতে পারি। ফলে প্রচুর গাছপালা উল্টে যাবে, গাছ ভেঙে যাবে, টিনের বাড়িঘর ভেঙে যাবে। আমি বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোতে সাইক্লোনের সতর্কবার্তা ছাড়া আর তেমন কোনো তথ্য পাইনি।
বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গের চ্যানেলগুলো ধরতে চেষ্টা করলাম, আমার বাসায় আমি তিন-চারটা বাংলা চ্যানেল দেখতে পাই, সেগুলো খুব বিস্তারিত প্রচার চালাচ্ছে। কর্মকর্তাদের, মন্ত্রীদের বক্তব্য এবং তাঁরা কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন সেটি প্রচার করছে। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে শুনলাম, কলকাতা শহরে ফ্লাইওভারগুলো গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণটি খুবই স্বাভাবিক, ১৫০-১৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইলে ফ্লাইওভার থেকে গাড়ি ছিটকে নিচে পড়ার আশঙ্কা আছে। অর্থাৎ তারা বিভিন্ন দিক থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কলকাতা শহরে সড়কের পাশে যে গাছপালা আছে তার শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ না–ও করে থাকতে পারে। সেগুলো উপড়ে পড়তে পারে, এ আশঙ্কা থেকে সতর্কবাণী প্রচার করা হচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়াতে যাতে রাস্তাঘাট বন্ধ না হয় সে জন্য কী করে দ্রুত রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা যেতে পারে, তার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।

একই ধরনের ভয়তো আমি খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের জন্য পেতে পারি। যশোরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাহলে রাস্তা দ্রুত পরিষ্কার করার জন্য পদক্ষেপের কথা এখনই ভাবতে হবে। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে আরও দেখলাম মাছের ঘেরকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে। তবে এ প্রসঙ্গে আমি কিছুটা আশ্বস্ত এ কারণে যে, বাংলাদেশের মৎস্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শের মধ্যে মাছের ঘের রক্ষা করার পরামর্শও আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ও ভালোই পরামর্শ দিয়েছে।

আম্পানের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়। পলিটেকনিক রোড, বরিশাল নগর। ছবি : সাইয়ান

আমি বলব, শুধু পরামর্শ দিলে হবে না। পানি ঢুকলে দ্রুত তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন আমদের দেশে দুঃখের বিষয় হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ পানি মন্ত্রণালয়ের, তথা তার অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের। আর কৃষি ক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়, তার অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। রাস্তাঘাটের দায়িত্ব হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের। আমরা আগে যেটা দেখেছি, ঘূর্ণিঝড়ের পর জীবনকে স্বাভাবিক করতে অনেক সময় লেগেছে। আক্রান্ত এলাকায় খাবার পানি সরবরাহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আইলা-সিডরের সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনী কাজটি সুচারুভাবে করেছে। আমরা আশা করব এবারও তারা এই কাজের জন্য প্রস্তুত। উপকূল অঞ্চলে কিন্তু প্রচুর নদী-নালা আছে সে জন্য সরকারের ত্রাণ কাজে নৌপথের সর্বাধিক ব্যবহার করবে বলে আমি আশা করছি।
এবার আসি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে। সাতক্ষীরা, খুলনা বাগেরহাটে এমনিতেই আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম। আমার হিসাবে আমাদের দেশে এই মুহূর্তে ১০ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন, সারা দেশে আছে পাঁচ হাজারের মতো। এগুলোর অধিকাংশ পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে। কাজেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মানুষ যাঁরা এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেবেন, কোনো মতেই তাঁদের পক্ষে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না। আমি ভয় পাচ্ছি যে এঁরা গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াবেন। তাহলে উচিত হবে ঝড় থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবাণুমুক্ত করা, তাঁদের পরনের কাপড়-চোপড় সাবানপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা, হাত-মুখ সাবানপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা এবং তাদের শরীরে তাপমাত্রা লক্ষ রাখা। যাঁদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আলামত পাওয়া যাবে, তাঁদের আলাদা করতেই হবে এবং তাঁদের আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও চিহ্নিত করে আইসোলেশনে পাঠাতে হবে।

আমি যে কথাগুলো বলছি, তার মধ্যে কোনো তাত্ত্বিক কথা নেই। আমরা এগুলো সবাই জানি। আমি তাগিদ দিচ্ছি, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। এ জন্য আমি স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করার ওপর জোর দেব। এই দায়িত্বটা যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ এবং ওয়ার্ড মেম্বারদের ওপর দেওয়া হয়, উপজেলা পর্যায়ে এই দায়িত্ব যদি উপজেলা পরিষদকে দেওয়া হয়, সেটিই ভালো। কারণ এই জনপ্রতিনিধিরা জানেন তাঁদের এলাকায় কারা বাস করেন। সরকারি অফিসে (ইউএও অফিস) হয়তো অনেক তথ্য আছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটারদের তালিকা আছে। সেখান থেকে অতি দ্রুত পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এবং ধরে নিতে পারি স্বাভাবিকভাবেই সরকার ত্রাণ কার্যক্রম চালাবে। এই কাজ যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হয়।

এ ক্ষেত্রে আমি আইলা ও সিডরের পরে খুলন ও সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী উপজেলাগুলোতে যেভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো হয়েছিল তার উদাহরণ টানতে চাই। ইউএনওরা তালিকা করেছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের মাধ্যমে এবং স্থানীয় এনজিওদের সহযোগিতা নিয়েছিলেন। কাদের সাহায্য দেওয়া হবে, সেই তালিকাটি অফিসের নোটিশ বোর্ডে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এতে বোঝা যাচ্ছে কার কাছে ত্রাণ যাচ্ছে এবং তাঁরাই যে প্রকৃত দাবিদার—এটি নিশ্চিত হয়েছে।

আইলা–সিডরের পর আমি তেমন অভিযোগ শুনিনি। আমিও ইউএনওদের অফিসে (সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চলে) যখন বিভিন্ন কাজে গিয়েছি তখন দেখেছি তাঁরা ত্রাণ কার্যক্রমের বা ত্রাণ গ্রহীতাদের তালিকা প্রকাশ করেছেন এবং সেই তালিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরি হয়নি। কাজেই আমি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াতে দ্রুত পদক্ষেপের পাশাপাশি স্বচ্ছতাও কামনা করছি।
আমাদের দেশের মানুষ ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হতে চান না। যদি সত্যিকারভাবে তাঁদের কাছ থেকে মতামত নিই, তাঁরা প্রথমেই বলবেন বেড়িবাঁধগুলো মেরামত করে দিন। আমাদের জমিগুলো একটু ঠিক করে দিন। সামনে বর্ষাকালে সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা করলে জমিগুলো লবণাক্ততা থেকে মুক্ত করা সম্ভব। হতদরিদ্রদের জন্য ত্রাণ এবং ভূমিহীনদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পুনর্বাসনের কাজে সরকার যদি একটি টাস্কফোর্স গঠন করে, তবে উপকূল অঞ্চল নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন দেশে এমন অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, বহু এনজিও কর্মী উপকূল সম্পর্কে খুবই ভালো জানেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে কী করতে হবে তার পরিকল্পনাটি যথা শিগগির করে ফেলা উচিত।

ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। লঞ্চঘাট এলাকা, বরিশাল নগর। ছবি : সাইয়ান

আমি লেখাটি শেষ করতে চাই আরেকটি কথা বলে, বাংলাদেশে সেই ব্রিটিশ আমলের সাইক্লোন ওয়ার্নিং সিস্টেম সামান্য একটু বদলেছে। নৌ আর সমুদ্রবন্দরের পার্থক্যটা ঘুঁচেছে। কিন্তু বন্দরের জন্য পূর্বাভাস দেওয়া হাতজোড় করে বলছি, বন্ধ করুন। মানুষের জন্য পূর্বাভাস দিন। পাশের দেশ ভারতে যেভাবে পূর্বাভাস দেয়, উন্নত বিশ্বে যেভাবে পূর্বাভাস দেয়, সেই পদ্ধতি অবলম্বন করুন। যখন মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হচ্ছে, তখন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৯ নম্বর সংকেত দেওয়া হচ্ছে। ৮, ৯ ও ১০ নম্বর সংকেতের মানে হচ্ছে প্রশাসনের দায়িত্ব, সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। কক্সবাজার অঞ্চলে তো এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়বে না। তাহলে সেখানে ৯ নম্বর সংকেত দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কেন একটা সংশয়ের মধ্যে ফেলা হচ্ছে?

এবারে আম্পানের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতজুড়ে যেভাবে সতর্কসংকেত দেওয়া হচ্ছে, সেটা ভালোভাবে স্টাডি করা যেতে পারে। আমাদের ভালো দিকটা হচ্ছে, আমাদের একটি স্ট্যান্ডিং অর্ডার আছে অর্থাৎ এর জন্য কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। কার কী দায়িত্ব, সেটা পরিষ্কার বলা আছে—এনজিওদের কী দায়িত্ব, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের কী দায়িত্ব, পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনীর কী দায়িত্ব, জেলা প্রশাসকের কী দায়িত্ব সবই লেখা আছে। এই আলোকে দুর্যোগ মন্ত্রণালয় চার-পাঁচ দিন আগেই প্রচুর নির্দেশনা প্রচার করেছে। অর্থাৎ আমাদের কী করতে হবে, কাগজে–কলমে তা বলা আছে।

কিন্তু সব কাজই নির্ভর করে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ওপর। এই পূর্বাভাসটি একটি দুর্বোধ্য ভাষায় দেওয়া বন্ধ করে জনমানুষের জন্য বোধগম্য করতে হবে। এই কথা আমি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তর হচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। এই মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন, যে কারণে হয়তো কেউই সহজে সমাধান করা যেতে পারে, এমন সমস্যাটির কাছে যেতে চান না। এইবারের সাইক্লোনের ওয়ার্নিং কী ধরনের বোকামির পরিচয় দিচ্ছে সেটি একটু পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অনেক। আসুন আমরা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই। দ্রুততার সঙ্গে মানুষকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় নামি।

ড. আইনুন নিশাত: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক