শৈশব থেকেই আমার সড়ক দুর্ঘটনা-ভীতি রয়েছে। রাস্তা পার হতে গেলে বা দূরের গাড়ি ভ্রমণে অস্বস্তিতে ভুগি। এর পেছনে কারণ আছে। আমার সাত বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যান। জ্ঞানবয়সে মৃত্যু সম্পর্কে ওটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। সকালে যে বাবা আমাকে নতুন শার্ট কিনে দেবেন বলেছিলেন, বিকেলে আচমকা তিনি ‘নাই’! শোনা গেল, লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তাঁকে। এ জিনিসটাও নতুন। ‘লাশকাটা ঘর’ আবার কী?
বড়দের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম, আমার মৃত বাবার দেহটা কাটা হবে। কী যে কষ্ট! তবে স্বজনদের চেষ্টায় লাশ অবশ্য কাটা হয়নি। পরদিন সকালে লাশকাটা ঘর থেকে কাটাছেঁড়া ছাড়াই এল লাশ। কিন্তু যে মুখটা দেখলাম, সেই চেহারা বহু দিন আমার রাতের ঘুম হারাম করেছে। কেড়ে নিয়েছে একটি শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ। এখনো এই বয়সেও সেই জড়তা রয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে চলাফেরায় অনেক সাবধানতা।
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। এ পর্যন্ত তিন-তিনবার সড়ক দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনবারই আমার বাহন ছিল রিকশা।
প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন ভোরের কাগজ পত্রিকায় কাজ করতাম। বাংলামোটরে ছিল পত্রিকার অফিস। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাংলামোটর থেকে বাসে করে ফার্মগেট এসে রিকশা নিলাম।
রাত ১০টার পর থেকে রাজপথ রিকশার জন্য ফ্রি। রিকশাচালক বয়স্ক। কিন্তু তেজ কম নয়। শাঁই শাঁই করে রিকশা চালাতে লাগলেন। আমি অনুনয় করে বললাম, ‘চাচা, একটু আস্তে চালান। অ্যাকসিডেন্ট হবে।’
চালক বললেন, ‘৩০ বছর ধইরা রিকশা চালাই। কিচ্ছু অইত না। আপনে খালি শক্ত হইয়া বন।’
আমি শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের টার্নিং পয়েন্টটা ছিল আরও খানিকটা আগে, বিআরটিএর অফিসের সামনে। যেকোনো মোড় ঘোরার আগে সাবধান হওয়াটা জরুরি। অভিজ্ঞতার অহংবোধে রিকশাচালক সে সাবধানতা ভুলে গেলেন। কালো একটা ট্যাক্সি ক্যাব শাঁ করে এসে মেরে দিল রিকশায়। আমি উড়ে গিয়ে পড়লাম রাস্তায়। দু-এক মিনিট জ্ঞান ছিল না। চোখ মেলার পর প্রথম অনুভূতিটা এমন, পটল তুললাম কি না। না, তুলিনি। মাথা ও পিঠে তীব্র ব্যথা। হাসপাতালে নেওয়ার পর মাথায় চারটা স্টিচ পড়ল। পিঠের একপাশে থেঁতলানো মাংস নিয়ে পড়ে রইলাম বিছানায়। সপ্তাহ তিনেক লাগল খাড়া হতে।
দ্বিতীয় দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভালোবাসা দিবসে। বিকেলের দিকে অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। কারওয়ান বাজার পেরিয়ে ডিমের আড়তে ঢুকল রিকশা। এ সময় আমার রিকশাচালক আরেক রিকশাচালকের সঙ্গে ওভারটেক প্রতিযোগিতায় নামল। একপর্যায় দুটো রিকশায় চাকায় চাকায় জড়িয়ে আমারটা গেল উল্টে। ডান হাত বাড়িয়ে যেন মিডঅনে কোনো জটিল ক্যাচ ধরছি, এমন ভঙ্গিতে উড়ে গিয়ে পড়লাম রাস্তার এক পাশে। ফুলহাতা গেঞ্জি আর প্যান্ট নিমেষে ফর্দাফাই। হাঁটুতে চোট পেলাম। কিছুটা জায়গা ছড়ে গেল। ডান হাতের কনুই থেকে খানিকটা মাংস খুবলে হাড় পর্যন্ত বেরিয়ে গেল। কাছেই এক ভাঙারির দোকানে লোহার শিট পিটিয়ে সোজা করছিল কয়েকজন কিশোর-তরুণ। তারা ছুটে এল। ড্রেসিং করে অ্যান্টিবায়োটিক লাগিয়ে সেবার পরাকাষ্ঠা দেখাল কিশোর-তরুণ। সান্ত্বনা দিল, ‘শুকরিয়া করেন। হাতের জন্য মাথাটা রক্ষা পাইছে!’
এবার অবশ্য শয্যা নিতে হয়নি। তবে হাতের ক্ষত ভরাট হতে সময় লেগেছে।
সর্বশেষ ঘটনা গত ১০ আগস্টের। দুপুরের দিকে অফিস থেকে ফিরছি। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। রিকশাচালককে আর পায় কে? তুফান বেগে রিকশা ছোটাতে লাগলেন। গতি কমাতে অনুনয়-বিনয়ে কাজ হলো না। অদম্য চালক হলিক্রসের পেছনে গির্জা পার হয়ে ডান দিকে ঘোরার সময় সবেগে এক ইজিবাইকের মুখে লাগিয়ে দিলেন রিকশা। ইজিবাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেটার চালক। রিকশার চাকা তাঁর ডান ঊরুতে গিয়ে আঘাত হানল। নিমেষে ওই চালকের প্যান্টের ডান পা খসে পড়ল। মাগো-বাবাগো বলে চিৎকার। অন্য সব ইজিবাইকের চালক ছুটে এসে হাতের সুখ মেটাতে লাগলেন রিকশাচালকের ওপর।
এদিকে রিকশাটা দুরন্ত বেগে কাত হতে হতে আমাকে ছুড়ে মেরেছে রাস্তায়। চিত হয়ে আছড়ে পড়লাম। মাথাটা রক্ষা পেল বটে, তবে মনে হলো শরীরের হাড়গোড় একটাও আস্ত নেই। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে খাড়া হতেই মনে হলো, ডান পায়ের পাতায় সাত মণ লোহা বেঁধে দিয়েছে কেউ।
ইজিবাইকের এক চালক আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলেন। মোবাইলে খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলের কাঁধে ভর করে কোনো রকমে বাসায় গেলাম। বিকেলে পা আর ফেলতে পারি না। বেশ ফুলে গেছে। কাছের এক বেসরকারি হাসপাতালে গেলাম। এক্স-রে হলো। তা দেখে চিকিৎসক বললেন, ডান পায়ের গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার। প্লাস্টার বাঁধা পায়ে থাকতে হবে সাত-আট সপ্তাহ। ডান পা একদম ফেলা যাবে না।
এখন প্লাস্টার-বাঁধা ডান পা বালিশের ওপর তুলে বসে থাকি। প্রয়োজনে ক্রাচে ভর করে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে এ ঘর থেকে ও ঘরে যাই। ছোট্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ জীবন। পদে পদে আরেকজনের ওপর নির্ভরশীলতা। দিন গুনিÑকবে যে খুলবে প্লাস্টার!
এতক্ষণ এত কথা বলার মর্মার্থ একটাই—একটা দুর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগে না। কিন্তু এর জের ইলাস্টিকের মতো। ক্রমেই দীর্ঘ হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় সংসার থেকে একজন রোজগেরে কর্তা বিদায় নিলে সে সংসারে অবনতির ১৪ প্যাঁচ লাগে। তুফান যায় পরিবারের বাকি সদস্যদের ওপর দিয়ে। আর কেউ আহত হয়ে চলার শক্তি হারালে বাকি জীবনজুড়ে পোহাতে হয় অশেষ দুর্ভোগ। অথচ দুর্ঘটনার ৯৫ ভাগের বেশি ঘটে চালকের কারণে। দেখা যায়, অধৈর্য চালক হয় বেপরোয়া গতিতে চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, নয়তো ওভারটেক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন।
আমি যে তিনটি দুর্ঘটনার শিকার, তিনটির জন্যই রিকশাচালকের গোঁয়াতুর্মি দায়ী। বেপরোয়াভাবে রিকশা না চালালে হয়তো এসব দুর্ঘটনা ঘটত না। চালক তিনি ছোট বা বড় যে যানেরই হোন না কেন, তাঁর সব সময় মাথায় রাখতে হবে যাত্রীর নিরাপত্তার বিষয় পুরোটাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল। যাত্রীকে শুধু বহন করাই তাঁর কাজ নয়, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোটাই আসল কথা। কিন্তু বেশির ভাগ চালক তা মনে রাখেন না। মাথায় থাকে কেবল ভেঙেচুরে এগিয়ে যাওয়া।
এই লেখাটি যখন লিখছি, আমার সামনে থাকা ইত্তেফাক-এর প্রথম পাতায় খবর ছাপা হয়েছে ‘বাস-ট্রাকের পাল্লাপাল্লিতে প্রাণ গেল হেলপারের’। সোমবার ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ঘটা এ দুর্ঘটনায় বাসের হেলপার (চালকের সহকারী) নিহত হন। পাল্লাপাল্লি না থাকলেও দুর্ঘটনা থেমে থাকে না। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায় পাতায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর। কোনটা রেখে কোনটা পড়ব? ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
ছোটবেলায় দেখেছি, একটা-দুটো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটত। তা নিয়ে দিনভর আলোচনা হতো। এখন সড়ক দুর্ঘটনা মুড়িমুড়কির মতো বিষয়। একটার আলোচনা হওয়ার আগেই আরেকটার খবর এসে হাজির। বেপরোয়া চালককে ঠেকাবে কে?
রাস্তায় যাব না, ফুটপাতে থাকব? সেটাও কি নিরাপদ? ২৭ আগস্ট বাংলামোটরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিআইডব্লিউটিসির হিসাব বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক কৃষ্ণা রায়। ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্টের বেপরোয়া গতির একটি বাস এসে একটা পা কেড়ে নিল তাঁর। তিনি কি কখনো আর ফিরে পাবেন দুই পায়ে চলার স্বাভাবিক জীবন?
বেপরোয়া বাস কতটা ভয়াবহ হতে পারে, ৫ সেপ্টেম্বর দেখা গেছে এর নমুনা। ওই দিন স্বামী নাজমুলের সঙ্গে মহাখালী আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারহা নাজ। ফুটপাতে উঠছিলেন, এ সময় ক্যান্টনমেন্ট মিনিবাস সার্ভিসের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে এসে সড়কবাতির খুঁটিতে মেরে দেয়। বেঁকে যাওয়া সেই খুঁটির আঘাতে মারা যান ফারহা। ইশরা নামের দেড় বছর বয়সী এক মেয়ে আছে তাঁর। এই শিশু কখনো বুঝবে সত্যিকারের মায়ের আদর কী?
এমন উদাহরণ টানা যায় ভূরি ভূরি। সমাধান নেই। চালক বেপরোয়া আছেই, প্রাণও ঝরছে অকাতরে। আর আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাটাই এমন যে চাইলেই চট করে বিকল্প পথ করে নেওয়া যায় না।
অনেক ক্ষেত্রে রিকশাচালকের কাছেই আমরা জিম্মি। আমি আমার এলাকার কথা বলতে পারি। নাখালপাড়া থেকে বহির্মুখী রাস্তাগুলোর মধ্যে তেজকুনিপাড়া হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যস্ত।
এ রাস্তায় একসময় শুধু রিকশা চলত। নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত ভাড়াও ছিল সহনীয়। ২০০০ সাল থেকে রিকশাভাড়া লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এখন তো ৩০ টাকার নিচে যেতেই চায় না। আর যদি বৃষ্টি হয় কিংবা একটু রাত হয়েছে, ফার্মগেট থেকে একটা রিকশাকে নাখালপাড়া নিতে জান বেরিয়ে যাবে। একজন না করেছে তো বাকি সবাই মাথা নাড়বে। এই ‘যাইতাম না’ যে কী কঠিন জিনিস, ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আর গেলেও আপনাকে ভাড়া দিতে হবে মুখ ব্যাদান করে।
রিকশাচালকদের এই তেজ কিছুটা কমেছে ইজিবাইকচালকদের আগমনে। হ্যাঁ, এটা অবৈধ। কিন্তু ভাড়া কম। যাত্রীপ্রতি ১০ টাকা করে নেয়। যায়ও দ্রুত। সকাল-বিকেল যাত্রীদের কর্মস্থলে যাওয়া বা ঘরে ফেরার যে তাগিদ থাকে, সেখানে অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ যানে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ কোথায়?
মাঝেমধ্যে পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে এসব ইজিবাইক যখন হাওয়া হয়ে যায়, ওই সময় রিকশাচালকেরা পুরো মাত্রায় সুযোগ নেন। কিচ্ছু করার নেই। যাত্রীরা জিম্মি। আবার ইজিবাইক আসে, যাত্রীরা হাঁপ ছাড়েন। তাঁদের ভাবনা, হোক না অবৈধ; যেতে তো পারছি, ভাড়া তো কম।
আমরা এত সব অনিয়ম নিয়ে কথার তুবড়ি ছোটাই। সমালোচনার ঝড় তুলি। পরিস্থিতি বদলায় না। যাত্রীসহায়ক কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা, যাত্রীরাও চলি আমাদের মতো। আর দুর্দৈবকে সামনে রেখে ঘাড়ের ওপর ওত পেতে থাকে ছায়াঘাতক।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক
shariful.bhuiyan@prothomalo.com