ঘরে বিদ্যুৎ, পেটে ‘খিল’

২১ মার্চ ২০২২। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা এল এ দিন। সরকারের সগর্ব ভাষ্য, শহর-বন্দর-গঞ্জ-গাঁয়ে একটি ঘরও আর বিদ্যুতের আওতার বাইরে নেই। প্রতিটি ভিটায় বিদ্যুৎ গেছে, সব ঘরই এখন আলোকিত। কিন্তু সবার আঙিনায় উনুন ঠিকঠাক জ্বলছে কি না, বিদ্যুতের আলোয় বসে অনায়াসে মাছের কাঁটা বেছে তারা দুটি ভাত খেতে পারছে কি না, তা নিয়ে কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। আলাপে না থাকুক, বাস্তবে পরিস্থিতির সারমর্ম অনেকটা এ রকম—ঘরে আলো আছে, হাঁড়িতে খাবার নেই। আলোর নিচেই থাকে অন্ধকার। পরিস্থিতির সঙ্গে চলনসই করে কথাটাকে বলা যেতে পারে—বিদ্যুতের আলোর নিচে ক্ষুধার অন্ধকার!

শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার দিনই জানা গেল, ৪৩ শতাংশ পরিবার খাবারের ব্যয়ে কাটছাঁট করে দিন কাটাচ্ছে। মানে, আধপেটা খাওয়া। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে মাছ-মাংসের টান ফেলেও তিন বেলা পেট ভরানো কঠিন স্বল্প আয়ের মানুষদের পক্ষে। কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বের খেলায় তারাও ‌‌‘তারকা খেলোয়াড়’। একটা শ্রমজীবী পরিবারের প্রত্যেক সদস্যেরও আয় আড়াই হাজার ডলার! এই ইনকামের পোশাকি নাম মাথাপিছু আয়, ডাকনাম ‌‘পরিহাস’!

মাথায় আড়াই হাজার ডলারের আয় নিয়েও পেট ভরাতে না পারার বাস্তবতাকে পরিহাস বললেও ‌‘কম’ বলা হয়। ক্ষুধার চোটে মানুষ চোখে যে অন্ধকার দেখে, বিদ্যুতের আলোর তা দূর করা সাধ্য নেই। সংখ্যাতত্ত্বের মারপ্যাঁচে এই মানুষদের যেভাবেই ‌‘তুলে’ ধরা হোক, তাদের অবস্থান মাটিতে।

কথায় চিড়ে ভেজে না, সংখ্যাতত্ত্বও ভাত জোগাবে না। কিন্তু এ দুটিরই এখন চল। সরকারের মুখে ফুটছে কথার খই, আর হাতে ধরা ‘উন্নয়নের বই’। এ বইয়ের পাতায় পাতায় সংখ্যা, সংখ্যার মাহাত্ম্য। অবকাঠামো নির্মাণ, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ইত্যাদি শিরোনামের নিচে গন্ডায় গন্ডায় আজদাহা অঙ্ক!

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ২০২০ সালের জুনে জানিয়েছিল, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। আর গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপ অনুযায়ী, ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
‘সংখ্যাতত্ত্বের সাধক’ সরকারের কিন্তু এসব সংখ্যায় আস্থা নেই। অথচ মাথাপিছু আয়ের সংখ্যাটি বলছে তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে, রীতিমতো ‘আসর’ বসিয়ে। সরকারে এমন একজনও নেই, যিনি ক্যামেরাকে কাজে লাগান না। কিন্তু সোনার বাংলার এই কথার দুয়ার থেকে বাস্তবের বঙ্গ-আঙিনা অনেক দূর!

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নানা সূচক বা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সরকারের আচরণ ‘দ্বিমুখী’। যা পক্ষে যায়, তাতে আপত্তি তো নেই বরং তাকে রীতিমতো বিজ্ঞাপনের ক্যানভাস করে তোলা হয়, আর যে কথাটি ভিন্ন সত্য তুলে ধরে, তা ‘ষড়যন্ত্রের অংশ’। ষড়যন্ত্র, নীলনকশা সম্পর্কে এত জানকারি সত্ত্বেও কেন যে তা রোখা যায় না, সেই প্রশ্ন আপনা–আপনিই ওঠে। কিন্তু এর উত্তর সাত ঘাট ঘুরেও পাওয়ার নয়।

গত বছরের জানুয়ারিতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানায়, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্য বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ, করোনার আগে তা ছিল ২১ শতাংশের মতো। সরকার সটান তা নাকচ করে দিল। সুতরাং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) খাবারের ব্যয়ে কাটছাঁটের তথ্যও সরকারের মনঃপূত হওয়ার কথা নয়।

এতে সরকারের ‘মন’ বোঝা যায়, কিন্তু সরকার মানুষের মনের খোঁজ রাখে, তেমনটা মনে হয় না। আসলেই তো মানুষের মনে কী আছে, কী বলছে মানুষের মন? এই প্রশ্নের সঙ্গে অবধারিতভাবে এসে পড়ে, কোন মানুষের মন? পাজেরো গাড়ি হাঁকানো মানুষের মন আর ফুটপাতে গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষের মন কী এক? উভয়েই আশরাফুল মাকলুকাত, একই রক্ত তাদের শরীরে। কিন্তু মানব ইতিহাসের নির্যাস বলে, এই দুজন মানুষের মন এক হতে পারে না, হয়তো তারা একই মন নিয়ে জন্মেছিল। প্রাচুর্যে-ক্ষমতায়-দম্ভে প্রথমজন ‘রাজা’ হলে দ্বিতীয় ব্যক্তি শুধু ‘প্রজা’ই নয়, একজন ‘মন-মরা’ মানুষ। অনটনে-অনাহারে-বঞ্চনায় তিনি আসলে একজন প্রাণবিক মানুষ, বৈরী বাস্তবতার জাঁতাকলে ‘মানবিকতা’ তার মরে যাওয়ারই কথা। প্রাণের ধুঁকপুঁকি থাকলেই কী কাউকে মানুষ বলা যায়? অবধারিতভাবে এসে যায় এ প্রশ্নও।

তাই মনের খোঁজ নেওয়ার বিপদ আছে! কিন্তু কিছু বিপদের মোকাবিলা আজ হোক বা কাল, করতেই হয়। বর্ষায় মাটি শুখা রাখতে পারবেন না, শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টির জন্য চাতক পাখি হতে হয়। তাই চাষাবাদ ঠিক রাখতে আবহাওয়ার চলন বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। মানুষের মনের আকাশেও রোদ-বৃষ্টি খেলা করে। সবার না হোক, একটা বৃহৎ শ্রেণির মানুষের মনের আকাশেও যদি একযোগে মেঘ গুড়গুড় করে ওঠে, বান দেখা দিতে পারে! দুর্যোগমাত্রই পূর্বাভাস দেবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

হাসান ইমাম সাংবাদিক
hello.hasanimam@gmail.com