সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনা লকডাউনের মধ্যে পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে যতই চটুল পোস্ট আর ঠাট্টা-মশকরা করা হোক না কেন, ধ্রুবতারার মতো সত্য এটাই যে বিশ্বজুড়ে লকডাউনে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন। এপ্রিলের শুরুতেই স্বয়ং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, বিভিন্ন দেশে লকডাউন পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় দ্বিগুণ হারে সহায়তা চাইছেন নারীরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় লকডাউনের প্রথম সপ্তাহেই অন্তত ৯০ হাজার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অভিযোগ এসেছে। ফ্রান্সে ঘরে নির্যাতনের হার বেড়েছে ৩২ শতাংশ। এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে প্রতিদিনই। সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সারা বিশ্বে অনলাইনে সাহায্য প্রার্থনার হার বেড়েছে ১২০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে লকডাউনের প্রথম চার সপ্তাহে ১৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা, অনাকাঙ্ক্ষিত আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন অনেকে।
নারী নির্যাতনে এমনিতেই বিশ্বে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনার ৭৭ শতাংশই ঘটে পারিবারিক পরিসরে। কাজের প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষ দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান বাড়ির বাইরে। ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে যে কয়েক ঘণ্টা বাড়িতে অবস্থান করেন, সেই সময়েই অনেকে নির্যাতকের ভূমিকায় আবির্ভূত হন। আর এখন করোনাজনিত লকডাউন, দুশ্চিন্তা ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাড়ির ভেতর চব্বিশ ঘণ্টা অনেকের জন্যই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রতিক্রিয়ায় বেড়ে যাচ্ছে নারী নির্যাতন।
ফেনীতে ফেসবুক লাইভে এসে স্ত্রীকে হত্যা করার মতো বিকৃত ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। পরিস্থিতির অবনতির জন্য অনেকে দায়ী করছেন হতাশাকে। কিন্তু হতাশা কি পুরুষের একার জন্য প্রযোজ্য? আর হতাশ হলেই কি পুরুষ যা খুশি তা-ই করতে পারেন? নারীর কি কোনো হতাশা নেই? উপার্জনক্ষম পুরুষের উপার্জনের পথ বন্ধ কিংবা তা হারানোর আশঙ্কা কি নারীকে হতাশ করে না? অনেক নারীও তো চাকরি হারিয়েছেন কিংবা চাকরি হারানোর আশঙ্কার মধ্যে আছেন। হতাশায় ভোগার অজুহাত পুরুষের জন্য খাটে বটে; কিন্তু নারীর জন্য খাটে না!
লকডাউন পরিস্থিতিতে গৃহস্থালি কাজে পুরুষের অংশগ্রহণের প্রসঙ্গটিকে সস্তা উপস্থাপনের মাধ্যমে ‘পুরুষ নির্যাতন’ হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। এসব ট্রল আর পোস্টগুলোতে অনুভূত হয় নারীর কাজের প্রতি পুরুষের অশ্রদ্ধা আর উদাসীনতা। সেই সঙ্গে নারীর প্রতি চরম অশ্রদ্ধার বিষয়টিও প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়। যদি তা না হতো, তবে নারীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই কাজগুলোকে ব্যঙ্গাত্মক আর হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হতো না। সমাজ কিন্তু আজও নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কাজগুলোকে আটপৌরে এবং সহজ-সরল কাজ হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করে। যদি তা-ই হয়, তবে এসব কাজের সঙ্গে পুরুষের সম্পৃক্ততা কেন নির্যাতনের পর্যায়ে পড়বে, তা বোধগম্য নয়। আসলে পুরুষ খুব ভালোভাবেই জানেন নারীর কাজ হিসেবে স্বীকৃত এই দায়িত্বগুলো পালনের যন্ত্রণা। আর তাই জেনেশুনেই এই কাজগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ এবং কষ্টসাধ্য কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ তাঁরা। ঠাট্টা-মশকরার মাধ্যমে এই কাজগুলোকে হালকা করার পেছনে চলে একধরনের পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার রাজনীতি। এই রাজনীতি পুরুষকে এসব গৃহস্থালি দায়িত্ব পালনের বোঝা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখে। একই সঙ্গে পুরুষ ধরে রাখে সংসারে তাঁর উচ্চ আসন।
তবে সময় এখন পাল্টাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক নারীর উপস্থিতি একদিকে যেমন নারীর কাছ থেকে সমাজের কাঙ্ক্ষিত সেবার ধারণা পাল্টে দিচ্ছে, ঠিক একইভাবে তা আবার পরিবর্তিত সময়ে পুরুষকে আরও যোগ্য হয়ে ওঠার তাগাদা দিচ্ছে। আগামী দিনের পুরুষকে নিশ্চিতভাবে ঘরের ভেতরের এবং বাইরের জগতের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। করোনা পরিস্থিতি পুরুষকে ভালোভাবেই জানান দিয়ে গেছে যে তাকেও গৃহকর্মে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। করোনা পুরুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নারীর সক্ষমতা। শুধু তা-ই নয়, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা কর্মজীবী নারীর ঘরের এবং বাইরের পৃথিবীর মধ্যে ভারসাম্য আনয়নের যুদ্ধ পুরুষ নিজের চোখে দেখেছে। তবে দেখেও না দেখা পুরুষের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। আবার অনেক পুরুষই আছেন, যাঁরা উদারভাবে এবং শ্রদ্ধাভরে নারীর কৃতিত্ব মেনে নিয়েছেন।
নারীরা দিন দিনই যোগ্যতর হয়ে উঠছে। তাই তাদের সঙ্গে যোগ্যতায় ভারসাম্য রাখতে হলে পুরুষকে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। নারী যেমন সংসারের ভেতরের এবং বাইরের কাজে সমান দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন পুরুষকেও একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীর কাজ নিয়ে ট্রল কিংবা ঠাট্টা-মশকরা করার জন্য হয়তো খুব বেশি সময় আর হাতে নেই। সিদ্ধান্ত তাই নিতে হবে এখনই। ঘর-গৃহস্থালিতে পুরুষের আনাড়িপনার বিষয়টি হয়তো ভবিষ্যতে উপহাসের বিষয়বস্তুতেই পরিণত হবে। তাই আজকের পুরুষকে হয়ে উঠতে হবে যোগ্যতর আর স্বাবলম্বী। ঘরের কাজ না জানার মধ্যে আজকাল আর কোনো কৃতিত্ব নেই। তাই পুরুষেরা, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা দিনগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করুন। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও আমাদের গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা মুক্ত করতে হবে। পরিবারের অভিভাবকেরা পুরোনো ধ্যানধারণা ভুলে শিশুর মেয়ে কিংবা ছেলে পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে তাকে গৃহস্থালির কাজে অংশীদারির শিক্ষা দিন। নিজে স্বাবলম্বী হোন, স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
purba_du@yahoo.com