মতামত

ঘনিষ্ঠতার প্রতীকী সফরে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল

২৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়
ফাইল ছবি

সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির শান্তি ও সংঘাত গবেষণার ভারতীয় অধ্যাপক অশোক সোয়াইন টুইটারে বাংলাদেশে তিন দিনে সহিংসতায় কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করেছেন, কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী গত ৭৪ বছরের ইতিহাসে কোথাও সফরে গেলে এমনটি কি কখনো হয়েছে? আর বাংলাদেশিদের মনেও প্রশ্ন, আমরা কি স্বাধীনতার এমন সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর কথা ভেবেছিলাম?

নিঃসন্দেহে সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনগুলোয় জৌলুশ ছিল, চাকচিক্য ছিল। বিশ্বনেতাদের উপচে পড়া শুভকামনা ছিল। মহামারির মধ্যেও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নেতাদের উপস্থিতি নিশ্চয়ই এ আয়োজনের উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে। কিন্তু এসব জাঁকজমক আর বিদেশিদের প্রশংসার আকর্ষণে যে দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ হয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা যেভাবে সংকুচিত হয়ে শুধু ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া অধিকারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন যেন তারই প্রতিফলন ঘটাল।

সহিংসতা ও অঘটন ঘটার আগে কথাগুলো কেউ না বললেও এখন এমন অভিযোগ উঠেছে। দেশের ২০ জন নাগরিক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সংকীর্ণভাবে ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্‌যাপন করেছে। তাঁরা এ কথাও বলেছেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিতর্ক থাকায় তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেই তা সংগত হতো। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের অভিযোগ থাকায় প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদ করার অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের রয়েছে। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত কয়েক দিনে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেভাবে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাতে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এ উদ্বেগ যে শুধু ২০ জন নাগরিকের, তা নয়; ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ এবং ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়ার পরও সামাজিক মাধ্যমে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে দিল্লিতে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেই আন্দোলন দমনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দাঙ্গাবাজ ও ছাত্রসংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এভিবিপি) কর্মীরা যেভাবে হামলা চালিয়েছিল, সেই ছবিগুলোর কথা অনেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের লাঠিসোঁটা নিয়ে মোদিবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হওয়ার ছবি পাশাপাশি দিয়ে অনেকেই এভিবিপির সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন।

হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের বিক্ষোভ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৬। সহিংসতা নিন্দনীয় এবং কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নিতে এর কারণ অনুসন্ধানও জরুরি। হাটহাজারীর বিক্ষোভকারীরা বলেছিলেন, ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে মোদিবিরোধী বিক্ষোভে হামলার প্রতিবাদে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। হামলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ভূমিকা নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, ঢাকায় বিক্ষোভে হামলা না হলে হাটহাজারীতে হয়তো বিক্ষোভ হতো না। অন্য কোথাও হয়তো তা ছড়াত না।

ঢাকার হাঙ্গামার মাত্রা কেমন ছিল, তা বোঝা যায় পুলিশের মামলার বিবরণে। বেলা দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটা—দুই ঘণ্টায় ১ হাজার ১৩৭টি গুলি বা প্রতি মিনিটে অন্তত ৯টি গুলি এবং ৯৩টি কাঁদানে গ্যাসের শেল, মানে প্রতি দেড় মিনিটে একটি করে শেল ছুড়েছে পুলিশ। স্মরণ করা যেতে পারে, হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে মোদির সফরের দিনে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে না বলেই বলা হয়েছিল। তাহলে কি বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ করে হেফাজত তার কথা রাখেনি? নাকি ওই বিক্ষোভ ছিল অন্যান্য ইসলামপন্থী দল এবং ক্ষুব্ধ লোকজনের এবং পরে তার নিয়ন্ত্রণ ও সুযোগ গ্রহণ করে হেফাজত? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অবশ্য এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। আমরা মূলত দেখতে চাই, যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তা কতটা সফল হলো?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সফরের আগে বলেছিলেন, ‘উনি (নরেন্দ্র মোদি) বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসছেন। এই কোভিড-১৯-এর পরে ভারতের বাইরে এটাই ওনার প্রথম সফর। সে জন্য উই আর ভেরি হ্যাপি।’ দুই দেশের মধ্যে অনিষ্পন্ন কোনো বিষয় যে এই সফরকালে নিষ্পন্ন হওয়ার আশা করা হচ্ছে না, উভয় তরফে সেই ইঙ্গিতও ছিল। তবু সফরের দ্বিতীয় দিনে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। তাঁদের উপস্থিতিতে পাঁচটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। তবে সেগুলোর একটিও অমীমাংসিত কোনো বিষয়ে নয়। পরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ চেয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। তবে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিস্তা যে কতটা অস্বস্তির কারণ, দুই তরফের বক্তব্যের ফারাকেই তার ইঙ্গিত মেলে। তবু পাঁচ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় সফরে সরকার খুশি।

খুশি দিল্লির নীতিনির্ধারকেরাও—বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতি এই সফরের অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেখানকার নির্বাচনী রাজনীতির একটি ফ্যাক্টর মতুয়া সম্প্রদায়কে কাছে টানার উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বলে অভিহিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মুখ খুলেছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশের অভিনেতা ফেরদৌসের ভিসা বাতিলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি জানতে চেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির ভিসা কেন বাতিল হবে না। সফরের আগেই আমরা জানতে চেয়েছিলাম যে সরকার কি ধরেই নিয়েছে, বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় আসবে। কেননা, এই সিদ্ধান্তের খেসারত আমাদের নানাভাবেই দিতে হতে পারে।

সরকার খুশি হলে দেশের সবাই যে সমভাবে আবেগাপ্লুত হবে, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মূল্যবান ভূমিকার কারণে দেশটির সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের সুবর্ণজয়ন্তীতে অংশগ্রহণের অবশ্যই আলাদা তাৎপর্য আছে। কিন্তু ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি নানা কারণে সমালোচিত এবং সেই বাস্তবতা যে বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল, তা এখন স্পষ্ট। আর দেশে ভারতবিরোধিতার অস্তিত্বও অস্বীকার করা যায় না। ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ এবং কয়েকটি বামপন্থী সংগঠনের কর্মসূচিতেও সাক্ষ্য মেলে যে ভারতবিরোধীমাত্রই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত বা রাজাকার—এমন ধারণাও ‍ঠিক নয়। বাংলাদেশ সব ধরনের দাবি পূরণের পরও ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য আচরণ ও হিস্যা দেওয়ায় অনীহা দেশটির শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের একটি কারণ।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে ঢাকা দিল্লির নিরাপত্তা-উদ্বেগ নিরসনে যে ভূমিকা রেখেছে এবং কথিত সংযুক্তি বা কানেকটিভিটি বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে যতটা লাভবান হয়েছে, তার বিপরীতে বাংলাদেশের চাওয়া কতটুকু পূরণ হয়েছে? যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিতে পণ্য চলাচল অবাধ হতে পারে, কিন্তু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাংলাদেশিদের চলাচল নিরাপদ হয় না। গুলি করে হত্যার নিয়মটির সাফাই দিয়ে বলা হয়, ‘অপরাধ হলে হত্যা বন্ধ হবে না’। অথচ অপরাধের দোষারোপ করা হলেও কোনো আইনেই বিনা বিচারে হত্যার বৈধতা নেই। প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রথম আলোয় নিবন্ধ লিখে ইউরোপ এবং আসিয়ানের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন: এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করুন, যেখানে আমাদের লোকেরা উপমহাদেশজুড়ে অধ্যয়ন করতে, কাজ করতে এবং অনায়াসে ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু তাঁর সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ অভিহিত করে পুরো অঞ্চলেই যে অস্থিরতা তৈরি করছে, সে কথা তো অস্বীকার করা যাবে না। যৌক্তিক আশঙ্কাতেই আমরা উদ্বিগ্ন।

এ কথা সত্য যে সরকারি পর্যায়ে ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক গত পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু একইভাবে অনেকে মনে করেন, ভারতের ব্যাপারে সমালোচনা ও সুপ্ত ক্ষোভও এখন আগের চেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ, পরপর দুটো নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ভোটের অধিকার হারানোর প্রশ্নে ভারতের সমর্থন। অন্য সব অপ্রাপ্তির ক্ষোভের তুলনায় এই হতাশা মোটেও কম কিছু নয়।

সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ের এ সহিংসতার কারণে অনেকে বলছেন, ইসলামি উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন জোট ছাড়াও প্রগতিশীলদের একটি অংশ এ ব্যাখ্যাকেই সামনে আনছেন। এ বিশ্লেষণে যে বিপদকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, তা হলো সরকারবিরোধী এবং ভারতবিরোধী সবাইকে হেফাজতের শিবিরভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা। এতে বাস্তবে হেফাজতই লাভবান হয়। বিরোধী দল বিএনপির দুর্বলতার বিকল্প হিসেবে তাঁরা আসলে হেফাজতকেই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করছেন। যাঁরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা দেখেন না, তাঁদের অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীলতার সীমাবদ্ধতায় নিশ্চিতভাবেই লাভবান হচ্ছে হেফাজতের মতো ইসলামপন্থীরা। বিরোধী দলকে স্বাভাবিক রাজনীতি করতে না দেওয়া এবং ভোটের সময়ে হেফাজতের সঙ্গে সখ্যের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ফলও সরকারেরই সৃষ্টি।

স্বদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দেওয়ার রাজনীতি নিয়ে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফরের লাভ-ক্ষতির হিসাব কষলে উদ্বেগ বাড়ে বৈ কমে না। সেটা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, তেমনই সত্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নেও।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক