মতামত

গ্রামোফোন কোম্পানি ও বিজেপির ভারত

সত্যটা হলো, ২২ কোটি মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতে রাজনৈতিক জীবন চলবে না
সত্যটা হলো, ২২ কোটি মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতে রাজনৈতিক জীবন চলবে না

লিভারপুলের বাসিন্দা ফ্রান্সিস ব্যারড বেশ নামকরা আঁকিয়ে ছিলেন। মার্ক নামে তাঁর এক ভাই ছিল। মার্ক মারা যাওয়ার পর তাঁর রেখে যাওয়া একটি সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফ, তাঁর কণ্ঠের কিছু গান এবং তাঁর প্রিয় কুকুর ‘নিপার’-এর মালিক হন ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস লক্ষ করছিলেন, তিনি যখন ফোনোগ্রাফে তাঁর প্রয়াত ভাই মার্কের কণ্ঠ বাজাতেন, তখন নিপার ছুটে আসত। সে ফোনোগ্রাফের চোঙার সামনে বসে হয়তো বোঝার চেষ্টা করত, কোত্থেকে কীভাবে তার আগের মালিকের কণ্ঠ ভেসে আসছে। এই দৃশ্য ফ্রান্সিস রং–তুলিতে এঁকে ফেলেন এবং ছবিটির নাম দেন ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’। ১৮৯৯ সালে দ্য গ্রামোফোন কোম্পানি ছবিটি তাদের লোগো হিসেবে ব্যবহার করে। কয়েক বছরের মধ্যে এটি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পুরো কোম্পানিরই নাম বদলে রাখা হয় এইচএমভি (হিজ মাস্টারস ভয়েস)। এভাবে নিপার নামের কুকুরটি অমর হয়ে রইল।

সম্প্রতি যখন দেখলাম, দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বিজেপির দুজন মুখপাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে (নূপুর শর্মাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং নবীন কুমারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে), তখন আমার সেই নিপারের কথা মনে পড়ছিল। কেন মনে পড়ছিল, সে কথাই বলছি।

৫ জুন নূপুর বিজেপির কাছ থেকে যে চিঠিটি পান, সেটির শুরুতে লেখা ছিল, ‘আপনি বিভিন্ন বিষয়ে দলের অবস্থানের বিপরীতে মতামত প্রকাশ করেছেন।’ এটি আমাকে বিস্মিত করেছে। মনে হয়েছে, চিঠির এই কথাগুলো ঠিক নয়। কারণ, নূপুর এবং নবীন বিজেপির অত্যন্ত অনুগত কর্মী এবং তাঁরা তাঁদের নেতাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। সেই মতো তাঁরা তাঁদের মত প্রকাশ করে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ২০১২ সালে গুজরাটে নির্বাচনী প্রচারের সময় নূপুর ও নবীনের মতো নেতা-কর্মীরা তাঁদের নেতা নরেন্দ্র মোদিকে বলতে শুনেছিলেন, ‘যদি আমরা পাঁচ কোটি গুজরাটি এক হই, তাহলে আলি-মালি-জামালিদের পরিকল্পনা আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’ হয়তো তাঁরা তখন ভাবছিলেন, এই ‘আলি-মালি-জামালি’ আবার কারা? ‘আমরা’টাই বা কারা? আর আলি-মালি-জামালিরা আমাদের ক্ষতি করতে চায় কেন?

২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মোদি একটি স্মরণীয় বক্তৃতায় ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘যদি আপনি একটি গ্রামে একটি কবরস্থান তৈরি করেন, তাহলে একটি শ্মশানও বানাতে হবে। কোনো বৈষম্য থাকা উচিত নয়।’ কথাগুলো নিশ্চয়ই নূপুর ও নবীনের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।

২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল অমিত শাহর দেওয়া ঘোষণাও তাঁরা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন। অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘আমরা সারা দেশে এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব। আমরা বৌদ্ধ, হিন্দু ও শিখ ছাড়া অন্য সব অনুপ্রবেশকারীকে একজন একজন করে খুঁজে বের করে দেশ থেকে তাড়াব। বিজেপির প্রতিশ্রুতি হলো, অনুপ্রবেশকারীদের কবল থেকে সবাইকে রক্ষা করা। এসব অনুপ্রবেশকারী হলো উইপোকার মতো। তারা আমাদের গরিবদের শস্য খেয়ে ফেলে।’ নূপুর ও নবীন ওই সময় নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিলেন, এগুলো সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তির উচ্চারিত সঠিক কথা ছিল।

দুঃখজনক সত্য হলো, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিন্দাসূচক একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তিনি মনে করেন, এই ঝড়ে তিনিও চলতে পারবেন এবং জীবন এভাবেই চলবে। সত্যটা হলো, ২২ কোটি মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতে রাজনৈতিক জীবন চলবে না। কিন্তু বিরোধীরা নয়, মোদিকে এবার সতর্ক করেছে বিশ্ব।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঝাড়খন্ডে একটি নির্বাচনী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতে যে লোকেরা ‘সমস্যা তৈরি করে’ তাদের ‘পোশাক দেখে চিহ্নিত করা যায়।’ নূপুর ও নবীন সম্ভবত সেই বক্তৃতা শুনেছিলেন এবং তাঁর কথা শুনেই সম্ভবত তাঁরা পোশাক দিয়ে মানুষ শনাক্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছিলেন।

উত্তর প্রদেশে বিধানসভার নির্বাচনী প্রচারণায় সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বারবার বলেছেন, ভোট অনেক দূর এগিয়ে গেছে। লড়াই এখন ২০–এর বিরুদ্ধে ৮০–এর। নূপুর ও নবীন নিশ্চয়ই এই কথাগুলো শুনেছেন এবং তাঁদের চেতনায় জ্বলে উঠেছে যে ‘২০ শতাংশ’ হলো শত্রু।

মুসলমানদের প্রতি বিজেপির মনোভাব কী, তা এম এস গোলওয়ালকারের (আরএসএসের ‘গুরুজি’) বক্তব্যই স্পষ্ট করেছে এবং এই মনোভাবের বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। বিজেপির কাছে মুসলমানরা ভারত বা ভারতের পার্লামেন্ট ও আইনসভায় কাঙ্ক্ষিত নয়। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে ৩৭৫ জন বিজেপি সংসদ সদস্যের মধ্যে এই মাসের শেষ নাগাদ একজন মুসলিম সংসদ সদস্যও থাকবেন না। বিজেপি ৪০৩ আসনের উত্তর প্রদেশ বিধানসভা কিংবা ১৮২ আসনের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে একটিও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি। ১১টি রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, আর এসব রাজ্যে মাত্র একজন মুসলিম মন্ত্রী রয়েছেন।

২০১২ সালের জুন মাসে এস ওয়াই কোরাইশি অবসর নেওয়ার পর থেকে ইসিআইতে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কোনো মুসলিম দায়িত্ব পাননি। এ ধরনের বঞ্চনার তালিকা দীর্ঘ। আমার মতে, নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার বিশ্বস্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে বিজেপির মতামত প্রতিফলিত করেছেন। তাঁরা তাঁদের প্রভুদের কণ্ঠস্বর শুনেছেন এবং নিজেদের মতো করে সেই কথা বলেছেন। আমার মতে, বিজেপি আধুনিক ভারতের গ্রামোফোন কোম্পানি।

কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বারবার বিজেপি এবং সরকারকে তাদের সংখ্যালঘুবিরোধী নীতি এবং ইসলামবিদ্বেষের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। তারা অ্যান্টি-রোমিও দল, লাভ-জিহাদ প্রচার, সিএএ, এনআরসি, ৩৭০ ধারা বাতিল, রাজ্য বিধানসভায় ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে বিল, হিজাব, হালাল এবং আজানের মতো ইস্যু দাঁড় করানোর বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করেছিল। এগুলো স্পষ্টভাবে ইসলামফোবিক। কিন্তু সরকার শোনেনি। তারা বধির হয়ে গেছে। যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অন্য ১৫টি দেশ বিজেপির মুখপাত্রদের দেওয়া বক্তব্যের নিন্দা করেছে, এতে সরকারের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

দুঃখজনক সত্য হলো, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিন্দাসূচক একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তিনি মনে করেন, এই ঝড়ে তিনিও চলতে পারবেন এবং জীবন এভাবেই চলবে। সত্যটা হলো, ২২ কোটি মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতে রাজনৈতিক জীবন চলবে না। কিন্তু বিরোধীরা নয়, মোদিকে এবার সতর্ক করেছে বিশ্ব।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

পি চিদম্বরম ভারতের রাজ্যসভার সদস্য এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী