মতামত

গ্রামকে ‘শহর’ না বানিয়ে হোক আলাদা উন্নয়ন

সম্প্রতি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি বিশেষ খবরে দৃষ্টি আটকে গেল। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও শ্মশান স্থাপন করতে এখন থেকে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘর নির্মাণে ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করতে হবে।

এই খবরের একটি দিক খুব আশাজাগানিয়া। এটা নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইউনিয়নের জন্যও ভৌত পরিকল্পনা বা ফিজিক্যাল প্ল্যানিং করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সামগ্রিক ভৌত পরিকল্পনা কেন গুরুত্বপূর্ণ? আলোচিত ভৌত পরিকল্পনার দার্শনিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি কী হবে? কারা এই ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়নে নেতৃত্ব দিলে মানুষ ও জগতের অন্য সবার সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে?

প্রথমেই বলতে হয়, স্বাধীনতার পরপরই দেশের সামগ্রিক ভৌত পরিকল্পনার আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থাপত্য-আচার্য মাজহারুল ইসলামের পরামর্শ নিয়ে সেদিকে এগোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেই উদ্যোগেরও মৃত্যু হয়।

মাজহারুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশটিকে খুব আন্তরিকভাবে গোছাতে চেয়েছিলেন। তিনি অনেকের কাছে এ জন্য সাহায্যও চেয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে। কিন্তু সাহায্য তো পাননি, বরং ১৯৭১ সালে প্রাপ্ত কাজগুলোও তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে কোনো একটি দেশের জন্য ভৌত পরিকল্পনামাফিক গ্রাম, অঞ্চল ও শহরকে গড়ে তোলাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এর কারণ, বাস্তব পরিসর (রিয়েল স্পেস) ভীষণভাবে সেখানকার জনগণের চিন্তার ধরন, ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, সেই প্রকৃতির সঙ্গেই আমৃত্যু ব্যক্তির নাড়ির বন্ধন জড়িয়ে থাকে। ব্যক্তি শুধু জমিনের ওপর আশ্রয় নেন, তা নয়, অনেক সময় এখানে তাঁর সামগ্রিক বিকাশও রচিত হয়। জনসাধারণের পারস্পরিক সম্পর্ক, সামগ্রিক যোগাযোগ, আধ্যাত্মিকতা, প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান, গৃহ নির্মাণ, বিনোদন, জ্ঞান-অর্জনসহ সবকিছুই সম্পাদিত হয় ওই ভৌত পরিসরে।

আমাদের দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায়শই পশ্চিমা চিন্তার অন্ধ অনুকরণ পরিলক্ষিত হয়। সব ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার আবেশ যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। সবকিছুতেই উপনিবেশের মাতৃরাষ্ট্রগুলোকে নকল করার একধরনের প্রবণতা এখানে বিরাজমান। এ জন্যই তো আমাদের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়শই শহরগুলোকে সুইজারল্যান্ড বা লন্ডন বানাতে চান!

তা ছাড়া একটি দেশের ভৌত বিন্যাস, অবকাঠামো বা স্থাপত্যের সৌকর্য দিয়ে দেশটি নিজের পরিচয় বিশ্ব সভ্যতায় তুলে ধরতে পারে। ইতিহাসে তার অবস্থান অনেকটা নির্ণীত হয় ভৌত স্থাপনার ভিত্তিতেই। এই বিবেচনা আরও প্রাসঙ্গিক হিসেবে সামনে আসে, যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অগ্রসর হতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, ভৌগোলিক কারণেও বাংলাদেশ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর কাছে এখন অত্যন্ত আগ্রহের একটি দেশ। তাই এখানকার ভৌত পরিসরের বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনা যেমন সুপরিকল্পিত হতে হবে, তেমনি তা সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে হবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায়শই পশ্চিমা চিন্তার অন্ধ অনুকরণ পরিলক্ষিত হয়। সব ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার আবেশ যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। সবকিছুতেই উপনিবেশের মাতৃরাষ্ট্রগুলোকে নকল করার একধরনের প্রবণতা এখানে বিরাজমান। এ জন্যই তো আমাদের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়শই শহরগুলোকে সুইজারল্যান্ড বা লন্ডন বানাতে চান! অথচ চরিত্রগত দিক থেকে প্রতিটি দেশ যেমন ভিন্ন ভিন্ন, ঠিক তেমনি একটি দেশের একেক অঞ্চল একেক রকম বৈচিত্র্যের অধিকারী। কোনো একটি দেশের নিজ ভূখণ্ডের মধ্যেই রয়েছে সীমাহীন বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য সেখানকার ভাষা, ভূপ্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, উৎপাদনব্যবস্থা, রুচি, নান্দনিকতাবোধ, আত্মীয়তার পরিচর্যা—বলতে গেলে সব ক্ষেত্রে।

তাই সবার জন্য এক রকম উন্নয়নচিন্তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এই যে সবাইকে অভিন্ন উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াস, তা প্রচণ্ডরূপে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। ইউরোপের আধুনিকতার দর্শনের ভেতর এই একমাত্রিকতার প্রবণতা তুমুলভাবে বিদ্যমান। এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক জ্ঞানচিন্তার আবহও এর বাইরে যেতে পারেনি খুব একটা।

সামগ্রিক উন্নয়নচিন্তায় শুধু নয়, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরাও যে পশ্চিমা রীতির মুখস্থ অভিন্নতার নীতি মেনে চলতে আনন্দ পান, তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনগুলোর একই রকম নির্মাণশৈলীর দিকে তাকালে বোঝা যাবে। আরও পরিষ্কার হবে, যদি আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নির্মিত উপহারের ঘরগুলোর দিকে তাকাই। পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য যে ঘর, উপকূলেও তা-ই। নদীতীরের জন্য যে নকশা, শহরতলিতে তা-ই অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। অথচ যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই জানেন, মানুষের ব্যবহারোপযোগী স্থাপনা নির্মিত হওয়া উচিত, সেই এলাকার ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় রেখে।

এই সূত্র ধরে বলা দরকার, দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য ভৌত পরিকল্পনা করতে চাইলে ‘সবার জন্য অভিন্নতার নীতি’ থেকে সরে আসতে হবে। এ জন্য দেশপ্রেমিক ও পরিবেশ-সংবেদী স্থপতিদের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। কারণ, স্থপতিরাই ভৌত পরিকল্পনার সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা ও অনুশীলন করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম স্বপ্ন দেখতেন, একদিন দেশে একটি ভৌত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় গঠিত হবে এবং এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমিনকে একদিন সুবিবেচনাপ্রসূত ও দূরদর্শী বিন্যাসের মধ্যে আনা সম্ভব হবে। ‘ঢাকা মহানগর সমন্বিত মহাপরিকল্পনা ২০২০-২০৫০’ প্রকল্পের জন্য যেমন বিভিন্ন বিষয়ের (স্থাপত্য, নৃবিজ্ঞান, নগর-পরিকল্পনা, পরিবেশবিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ অধ্যয়ন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি) বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটি করা হয়েছে।

তেমনি গোটা দেশের আঞ্চলিক ও গ্রামীণ পরিকল্পনার জন্য এ রকম কোনো পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছে কি না, তা জনগণকে জানানো যাক। না হলে তা এখনই সংগঠিত করাটাই সমীচীন হবে। এর কারণ, বর্তমানে বিপুল মানুষ নিজস্ব উদ্যোগে যেমন বহু স্থাপনা নির্মাণ করছেন, তেমনি সরকারও অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব স্থাপনা একবার গড়ে উঠলে একেবারে নির্মল অর্থে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে। আরেকটি কথা, সার্বিক ভৌত পরিকল্পনার জন্য সাধারণ জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণও থাকা চাই, নামকাওয়াস্তে হলে চলবে না।

শহুরে চিন্তা দিয়ে গ্রামকে নির্মাণ করতে চাইলে তা খুব বিবেচনাপ্রসূত কিছু হবে না। তাই গ্রামের মৌলিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রবল ও পয়সাওয়ালাদের অন্যায় দাপট থেকে গ্রামের মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। সেখানে আইনের শাসন ও মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।

জনগণের সত্যিকারের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান রেখে বিশেষজ্ঞদের দেশপ্রেম ও প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে ভৌত পরিকল্পনার কাজটি রচিত হওয়া দরকার। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সরকার সম্প্রতি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’। সেই প্রকল্পের জন্য ‘গ্রামীণ জন-প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা (২০১৯) প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন খাতের জন্য লিপিবদ্ধ জনপ্রত্যাশার যে চিত্র আমরা পাই, তা আমাদের ওই ঔপনিবেশিক উন্নয়নচিন্তা প্রভাবিত একমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থার কথাই মনে করিয়ে দেয়। গ্রামগুলো যদি কেন্দ্রমুখী চরিত্রের শহরের মতো হয়ে ওঠে, তাহলে শহরের সিংহভাগ কদর্যতাও দিনে দিনে গ্রামে আস্তানা খুঁজে নেবে।

বলা দরকার, নিবিড় শহরায়ণ বিশ্বায়নেরই নিষ্ঠুর উপজাত। গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিপন্ন করে শাসনব্যবস্থা বিকশিত হয়। মধ্যস্বত্বভোগী, বড় ব্যবসায়ী ও আমলাদের বিকাশ ঘটে এখানে। শিল্পকারখানার জন্য সস্তা শ্রমিকের জোগান নিশ্চিত করার বিষয়টি কাঠামোগতভাবেই শহরে গুরুত্ব পায়। অধিকাংশ মানুষের জন্য সার্বিক মানবীয় সুযোগ সৃষ্টি করাটা এখানে খুব একটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। বসবাসের জন্য বিরাটসংখ্যক মানুষকে ঠাঁই নিতে হয় অস্বাস্থ্যকর ও অপরাধপ্রবণ বস্তিতে। ন্যূনতম নাগরিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রবল গতিতে ছুটতে হয় মানুষকে। আর নিরন্তর ছুটতে গিয়ে এই শহর নামের নিষ্ঠুর পরিসরে মানুষ অধিক মাত্রায় মানসিক বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন। শহরে ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসের কাঁচামাল অন্যত্র থেকে নিয়ে আসতে হয়। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন রকম দূষণের। পানি, মাটি, বাতাস, আলো, শব্দ ও দৃশ্যদূষণে নগরের মানুষ আজ একেবারে নাকাল। টাকাকড়ির মতো কৃত্রিম সম্পদের ওপর শহর খুব নির্ভরশীল হয়। পয়সা ছাড়া সেখানে একমুহূর্তও চলে না। সেই অর্থে শহর স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় মোটেই।

এর বিপরীতে গ্রাম কিন্তু আত্মনির্ভরশীল। সেখানে প্রকৃত সম্পদের (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ভেষজ উদ্ভিদ ইত্যাদি) অঢেল উৎস এখনো বিদ্যমান। সুতরাং শহুরে চিন্তা দিয়ে গ্রামকে নির্মাণ করতে চাইলে তা খুব বিবেচনাপ্রসূত কিছু হবে না। তাই গ্রামের মৌলিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রবল ও পয়সাওয়ালাদের অন্যায় দাপট থেকে গ্রামের মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। সেখানে আইনের শাসন ও মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, মানুষসহ জগতের সব প্রাণের সর্বাধিক কল্যাণ রচনা করাটাই হবে উন্নয়নের প্রধানতম লক্ষ্য। সেই অভিপ্রায় নিয়েই যেন প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর জন্য ভৌত পরিকল্পনা গ্রহণ যায়।

কাজী মসিউর রহমান পরিবেশকর্মী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক।
mosiurrahman1971@gmail.com